মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ চরিত্র,উত্তম চরিত্রের তুলনীয় কিছু নেই

রেজাউল করীম রেজাউল করীম

ইসলামি সংগীত শিল্পী

প্রকাশিত: ৯:২৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৯, ২০২২ 564 views
শেয়ার করুন

শরিয়ত যেসব স্বভাব ও কাজের জন্য মানুষকে প্রশংসিত ও উৎসাহিত করে সেগুলোকে আখলাকে হাসানা বলে। আর যেসব স্বভাব ও কর্মের জন্য নিন্দিত ও তিরস্কৃত করে সেগুলোকে আখলাকে সায়্যিয়াহ বলে। আল্লামা জুরজানি (রহ.) বলেন, অন্তর থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও শরিয়তের আলোকে যেসব প্রশংসনীয় আচরণ প্রকাশ পায় তার নাম সচ্চচিত্র। আর যদি স্বভাবগতভাবে মন্দকর্ম প্রকাশ পায়, তার নাম দুশ্চরিত্র। (আল-আখলাকুল ফাজেলা, পৃষ্ঠা : ৩১)।

মানুষের দুই-এক দিনের আচরণ তার স্বভাব বা চরিত্র হতে পারে না। বরং সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র তখনই বলা হবে, যখন এগুলো স্বভাবগতভাবে প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ বিন সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা বলি, এটি (সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র) একটি বদ্ধমূল বা স্থায়ী অবস্থা। যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পদ ব্যয় করে, তাকে দানশীল বলা যাবে না। কারণ এটি তার নিজস্ব স্বভাবে নেই। অনুরূপভাবে, কেউ রাগের সময় কষ্ট করে চুপ করে থাকার ভান করলে, তাকেও ধৈর্যশীল বলা যাবে না (আল-আখলাকুল ফাজেলা)পৃষ্ঠা: ৩১)।

মোট কথা, স্বভাবগত উত্তম ও প্রশংসনীয় কর্মসমষ্টির নাম আখলাকে হাসানা। আর স্বভাবগত মন্দকর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে সায়্যিয়াহ।

আখলাকে হাসানার গুরুত্ব ও ফজিলত

আখলাকে হাসানার প্রতি শরিয়ত যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। কারণ, আখলাকে হাসানা নামের সজীব বৃক্ষটির মজবুত পরশে মানবজীবনের প্রতিটি পরত হয়ে ওঠে ক্লেশমুক্ত, নির্ঝঞ্ঝাট ও পরিচ্ছন্ন। তাই উভয় জাহানে সফলতা লাভের মানদ- নিরূপণ করা হয়েছে আখলাকে হাসানাকে। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিকে সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো।’ (মুত্তাফাক আলাইহি, বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হাদিস ; ৪৮৫৪, ৯/১৬৮; ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ)।

রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কেয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে, তা হচ্ছে উত্তম চরিত্র।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০০২; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৯৯, ‘সচ্চরিত্র’ অধ্যায়)।

অন্য হাদিসে আবু দারদা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘মুমিনের মিজানের পাল্লায় সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী কোনো কিছুই রাখা হবে না। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বদা (দিনে) সিয়াম পালনকারী ও (রাতে) নামাজ আদায়কারীর মতো।’ (তিরমিজি, হাদিস  : ২০০৩; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৯৮)

দিনভর রোজা রেখে ও রাতভর সালাত আদায় করে কোনো ব্যক্তি যে নেকি পাবেন, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সচ্চরিত্রের কারণে সে পরিমাণ নেকি লাভ করবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে তার চরিত্রকে সুন্দর করেছে, আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য জামিন হবো।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০০)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে  বলতে শুনেছি, ‘ইমানের দিক দিয়ে সর্বাধিক কামিল ব্যক্তি সে, যার চরিত্র সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১১৬২; আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬৮২)

কামিল মুমিন হওয়ার জন্য এ হাদিসে চরিত্রের পূর্ণতার শর্তারোপ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন জিনিস বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০০৪)

রাসুল (সা.) বলেন, সৎকাজ হলো উত্তম স্বভাব। আর পাপ কাজ হলো, যে কাজ তোমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি করে; আর তুমি ওই কাজটি জনসমাজে প্রকাশ পাওয়াটা অপছন্দ করো। (মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হাদিস : ৪৮৫২, ৯/১৬৭)।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম, সে আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আর কেয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০১৮)

এমন আশাব্যঞ্জক হাদিস গভীরভাবে পড়লে নিশ্চয়ই তাকওয়াশীল হৃদয় উত্তম চরিত্র অর্জনে উদ্বুদ্ধ হবে। এক হাদিসে এসেছে, সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোন জিনিসটি সর্বোত্তম যা মানব জাতিকে দেওয়া হয়েছে? তিনি বলেন, সচ্চরিত্র (মিশকাত, হাদিস : ৫০৭৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হাদিস : ৪৮৫৭, ৯/১৬৯)

রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ (মিশকাত, হাদিস : ৫০৯৭, বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হাদিস : ৪৮৭০, ৯/১৭২)

রাসুল (সা.) ছিলেন সচ্চরিত্রের মূর্তিমান আদর্শ। তার চরিত্রের প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কলাম, হাদিস : ৪)। তিনিও তার চরিত্রকে আরও সৌন্দর্যম-িত করার জন্য বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার গঠন সুন্দর করেছ, সুতরাং আমার চরিত্রকে সুন্দর করো।’ (আহমাদ ও মিশকাত, হাদিস : ৫০৯৯, বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হাদিস : ৪৮৭২, ৯/১৭৩)। সুতরাং সচ্চরিত্র মানবজীবনের জন্য কতটা প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ, তা এই সহজেই অনুমেয়।

রাসুল (সা.) অন্য হাদিসে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের বলব না, তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি কে?’ তারা বললেন, অবশ্যই। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে তিনিই সর্বোত্তম, যিনি বয়সে বড় এবং স্বভাব-চরিত্রে ভালো।’ (আহমাদ, মিশকাত, হাদিস : ৫১০০)

রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘আমি কি তোমাদের সংবাদ দেব না, যার ওপর জাহান্নাম হারাম আর জাহান্নাম যার জন্য হারাম? তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মস্তিষ্ক শান্ত, স্বভাব কোমল, মানুষের সঙ্গে মিশুক ও সহজ-সরল।’ (আহমাদ, তিরমিজি, মিশকাত হাদিস : ৫০৮৪)।

সচ্চরিত্রের কারণে একজন মানুষকে সর্বোত্তম ঘোষণা করা হয়েছে। বিভীষিকাময় কেয়ামতের দিন আল্লাহ যখন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ চুকাতে মানুষের আমল মিজানের পাল্লায় তুলবেন, তখন সচ্চরিত্র সৌভাগ্যের স্বপ্নকাঠি হয়ে সবচেয়ে বেশি ভারী হবে।

ব্যক্তির উত্তম-ভালো স্বভাবগুলো তার দুর্দিনে কতটা ফলদায়ক হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারবে না। সচ্চরিত্রের জন্য সে ‘সনাহেবুস সাওম’ বা সারা বছর সিয়াম পালনকারী ও ‘সাহেবুস সালাত’ অর্থাৎ সারা রাত নামাজ আদায়কারীর মতো সওয়াব পাবে। হাদিসে সচ্চরিত্রের জন্য এত এত নেকি ও মর্যাদা ঘোষণা করাতে সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে। বস্তুত সচ্চরিত্র সামাজিক শৃঙ্খলার হাতিয়ার। এটি ছাড়া সুখ-শান্তির কল্পনা অবান্তর। সচ্চরিত্র অর্জনে আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া, প্রচেষ্টা চালানো একান্ত কর্তব্য।