কাজের চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাছাড়া করোনায় কারাগারের মত কড়া বিধি নিষেধে বাইরে বের হয়নি বহুদিন। সহজ সুযোগ হাত ছাড়া না করে পাড়ি দিলাম, আমিরাতের সাগর আর পাহাড়ের শহর খোরফুক্খানের উদ্দেশ্য। ওমান উপসাগরের এই শহরটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ’র অর্ন্তভুক্ত তবে ফুজাইরার নিকটবর্তী। রাজধানী আবুধাবী থেকে 263 কিলোমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দুবাই থেকে 129 কিলোমিটার উত্তরে খোরফুক্খানের অবস্থান। আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় কিভাবে ঘুমায় কিংবা,আত্মার সাথে সমুদ্র কিভাবে আঁতাত করে সেই সত্যতার সাক্ষাৎ পেতে আপনাকে আসতে হবে খোরফুক্খানে। গভীর প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর, বৈচিত্র্যময় হাজর পর্বতমালা, নয়াভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন কবর খানা, পাথরের দ্বীপ, স্থলভিত্তিক টানেল এবং বাংলাদেশী প্রধান ফ্রাইডে মার্কেট এই শহরকে অনন্যতা এনে দিয়েছে।

খুব সকালে দুজন সহকর্মীকে নিয়ে উৎসবের সাথে যাত্রা শুরু করলাম। নবীণ সহকর্মী সম্প্রতি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে তাই দারুণ উৎসাহ নিয়ে গাড়ী ছুটালো। প্রায় দেড়শো কিলোমিটার চালিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিল ফলে নিজেই বসে পড়লাম ড্রাইভিং সিটে। রাজধানী শহর আবুধাবি থেকে শারজাহ হয়ে এমিরেটস রোড ধরে নির্দেশনা বোর্ডের E311 চিহৃ ধরে খোরফোক্খান বাইপাস সড়কে মিশে গেল আমাদের গন্তব্যে। শারজাহ সরকার ছয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তৈরী করেছে পাহাড়ী পথের এই মসৃন রাস্তা।এই বাইপাস সড়কটি দুবাই থেকে খোরফুক্খানের দূরত্ব অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। 90 মিনিটের রাস্তা এখন পাড়ি দিতে পারেন মাত্র 45 মিনিটে।

রাস্তার দুধারে সারি সারি খাড়া গম্ভীর কালো পাথরের পাহাড় মনে হবে আকাশটাকে আড়ালে রেখে আপনাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছে । পাহাড়ের ঘনত্বের কারণে এখানে শব্দের প্রতিদ্থধনি হয়, গাড়ীর শব্দিটি ও পূরনায় গাড়ীতে ফিরে আসে এমনকি প্রথম বিমান ভ্রমনের মত কানে বায়ুচাপ অনুভব করতে পারেন। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই ”আলহাজর” পর্বতমালার মাঝদিয়ে এই রাস্তাটি সম্প্রসারিত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের প্রায় সাতশত কিলোমিটার এলাকা জুডে কঠিন শিলার পর্বতের অবস্থান। ভারী যানবাহন মুক্ত নিরিবিলি এই রাস্তায় আপনি দারুন রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাবেন যখন আপনার গাড়ী গভীর পাহাড়ের সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দিবে। আবর আমিরাতের দীর্ঘতম পাঁচটি স্থালভিত্তিক টানেল এটি। পরপর পাঁচটি স্থল টানেলের বুকের ভেরত দিয়ে আপনি শহরে প্রবেশ করবেন।শহরের প্রবেশ পথের ধারের “আল রুফসা” লেক আপনার দৃষ্টিকে শীতল করে তুলবে। চারিদিকে সুউচ্চ পাথুরের পাহাড়ের খাদে মনোমুদ্ধকর নীল জলরাশি আনান্দের উৎস হয়ে উঠল।

গাড়ীর উইন্ড খুলতেই নীলজল ছুয়ে দেখতে মন অস্থির হয়ে উঠল। যান্ত্রিক বোট বা ছোট্ট নৌকা নিয়ে ছুটে যেতে পারেন পাহাড়ের বাকে। সৌন্দয উপভোগের জন্য লেকের সুউচ্চ পাড়ে নিরিবিলি বসার ব্যবস্থা. গাছপালায় ঘেরা গভীর সবুজে মন জুড়িয়ে নেওয়া এবং পাহাড় ও সবুজের স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য তুলে নিতে পারেন চমৎকার লোকেশানের কিছু ছবি। লেকটি কিছুতে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু সমুদ্রের প্রতি সুতীব্র টানে তম্ময় হয়ে সৈকতে দিকে রওয়ানা হলাম।হাতে সময় থাকলে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে পারেন এই লেকের পাড়ে।খোরফুক্খান সৈকত নিঃসন্দেহে আরব আমিরাতের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্র সৈকত। গাড়ী থেকে নেমে সৈকতে পা রাখতেই মনটা অন্য রকম অনুভূতিতে ভরে গেল।পৃথিবীর দুটি জিনিস বিশালতায় ভরা; আসমান আর সমুদ্র। আসমান ছোঁয়া না গেলেও সাগরের বিশালতা ছোঁয়া যায়। আমার জীবনে এত সৌন্দর্যময় সৈকত আর দেখা হয়নি। এর চেয়ে সৌন্দর্য হয়ত স্বর্গেই দেখা সম্ভব। তিন দিক দিকে ঘেরা অসীম উচ্চ পর্বতমালা যেন আকাশে আয়েশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর সামনে অসীম সাগর নীলিমাময়। সেই ছায়া সাগরে পড়ে মোহময় মহিনী আবছায়া তৈরী করেছে।

নির্মল ও পরিচ্ছন্ন সৈকতের আকাশে তুলতুলে সচ্ছ মেঘ যেন তাকিয়ে আছে। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ মনকে অস্থির করে তুললো। সাতারের পোশাকে নেমে পড়লাম নীল জলে । ঝাঁপাঝাঁপি দুষ্টুমিতে মেতে উঠলাম কিছুক্ষণ। বিচ পুলিশ এসে হুইসিল বাজানো শুরু করলো। ভড়কে গেলাম ভয়ে, না জানি কি আইন অমান্য করলাম। পরে বুঝলাম কিছু ভারতীয় সাতারের পোশাক ছাড়া নেমে পড়েছে পাশে।মজার এই সৈকতে সুবিধা আছে বই পড়ার, বারবিকিউ পার্টি কিংবা জগিং করার ; আছে ক্রুজ প্যারাসেইলিং অথবা সার্ফিং করার সুযোগ। এখানে মাত্র ২০ দিরহাম দিয়ে স্পিড বোটে ঘুরে আসতে পারেন নিকটবর্তী “শার্ক আইল্যান্ড” থেকে। আইল্যান্ডটি আসলে সাগরের গভীর থেকে গজিয়ে ওঠা হাজর পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ। নানা প্রজাতির মাছ,কচ্ছপ ও হাঙ্গরের অভয়াশ্রম এই বীচ এলাকা। সৈকতের সন্নিকটে কৃত্রিম জলপ্রপাত আরেকটি আনান্দের খোরাক জোগায়। খোরফুক্খানের অন্যতম আকার্ষণ ফ্রাইডে মার্কেট। এই মার্কেটে পাওয়া যায় নানা রকম তাজা ফল, মাটির তৈরী পাত্র এবং নানা রকমের কার্পেট বিশেষ। নাম ফ্রাইডে মার্কেট হলেও আসলে সপ্তাহের সব দিনই খোলা থাকে দোকানগুলি। মজার বিষয় হচ্ছে এখানে বাংলাদেশের মত জিনিস দরদাম করে কিনতে হয়।কারণ বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত এই দোকানিরা এটা উপভোগ করে।

পাহাড়ে চড়া, নয়াভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন কবর খানা, পাথরের দ্বীপ, স্থলভিত্তিক টানেল কোনটা রেখে কোনটা দেখি করে সময়ের সম্মুখযুদ্ধে শেষ হয়ে গেল । এ পর্যটন নগরীতে দিন শেষ হয়ে যায় কিন্তু প্রাপ্তির পিপাসা প্রান্তে পৌছে না।বার বার প্রকৃতি আহবান করে অতি প্রিয়জন হয়ে।