‘সত্যবলা বারণ’ গ্রন্থে ছড়াকার সত্য বলেছেন অনায়াসে

আবু মকসুদ আবু মকসুদ

কবি, সম্পাদক-লন্ডন

প্রকাশিত: ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪ 603 views
শেয়ার করুন

 

আমাদের ছড়া সাহিত্যে দুজন লুৎফুর আছেন—একজন লুৎফর রহমান রিটন, অন্যজন শুধুই লুৎফুর রহমান। নামের বানানে অবশ্য সামান্য কম-বেশি আছে—একজনের নামের বানান লুৎফর, অন্যজন লুৎফুর। কিন্তু নামের এ সামান্য পার্থক্য তাঁদের সাহিত্যিক পরিচয়ে কোনোভাবেই প্রভাব ফেলে না। দুজনই ছড়া সাহিত্যে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করেছেন।

লুৎফর রহমান রিটন ইতোমধ্যে ছড়া সাহিত্য জয় করে ফেলেছেন। তিনি ছড়া সাহিত্যের ঘোষিত কিংবা অঘোষিত সম্রাট। বাংলা সাহিত্যের ছড়ার অংশ লুৎফর রহমান রিটনকে ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না। শুধু তাই নয়, তিনি এই প্রজন্মের অনেক তরুণ লেখকের জন্যও প্রেরণা হয়ে উঠেছেন। তাঁর লেখার শক্তি এবং ভাবনায় ছড়ার যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, তা সত্যিই অসাধারণ।

লুৎফর রহমান রিটনের ‘ছড়া সমস্ত’ বইয়ের ভূমিকা কে লিখেছেন জানলে অবাক হবেন—ভূমিকা লিখেছেন খোদ অন্নদাশঙ্কর রায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের পরিচয় যদি জানতে চান, তাহলে আমি এক লাইনে পরিচয় দেই—”তেলের শিশি ভাঙলো বলে/খুকুর ‘পরে রাগ করো/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো।” এতটুকু বললেই বোধহয় বোঝা যায়, তিনি কত বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্বীকৃতি লুৎফর রহমান রিটনের জন্য নিঃসন্দেহে এক বিশাল প্রাপ্তি।

এই ভূমিকাটুকু দেওয়ার কারণ হচ্ছে, আমি অন্য ছড়াকার লুৎফুর রহমানকে আমার মতো করে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। তাঁর কয়েকটি বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন খোদ লুৎফর রহমান রিটন। তিনি সেখানে লিখেছেন ‘তার সাথে আমার অনেক মিল, নামে, ছড়ায় আর প্রবাস যাপনে’ এখানে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। অন্নদাশঙ্কর রায় যেভাবে লুৎফর রহমান রিটনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই লুৎফর রহমান রিটন স্বীকৃতি দিচ্ছেন লুৎফুর রহমানকে। এটি আমাদের ছড়া সাহিত্যের একটি সুন্দর সংযোগের উদাহরণ।

এখন যদি বলি, “রতনে রতন চেনে,” তাহলে সেটা অতিরঞ্জিত হবে না। তরুণ ছড়াকার লুৎফুর রহমান বাংলা ছড়া সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন। ছড়া সম্রাট লুৎফর রহমান রিটন তাঁকে চিনতে কোনো ভুল করেননি। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয় তার ছড়া। ছড়ার বই বের হয়েছে ১২টি। এর মেধ্য সিলেট বিভাগের গণহত্যা নিয়ে রচিত ছড়ার বই বাংলা ছড়া সাহিত্যে গণহত্যার ইতিহাস নিয়ে প্রথম কোন বই হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং লুৎফর রহমান রিটন। লুৎফুর ছড়া নিয়ে খেলতে জানেন। একই ছড়ার বিষয় আর ফর্মেট তার নিজের আলাদা পরিচয় করে নিয়েছেন আপন মেধায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত লুৎফুর রহমানের ‘সত্য বলা বারণ’ নামক ছড়ার বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। হাতে এসেছে ঠিক নয়—লন্ডন বইমেলা থেকে আমি আগ্রহ করে সংগ্রহ করেছি। নতুন লেখকদের বইয়ের প্রতি আমি সবসময়ই আগ্রহী, কিন্তু এই বইটি নিয়ে আগ্রহের কারণ ছিল ভিন্ন। এটি কেবল একটি ছড়ার বই নয়, এটি একটি সমাজ-সচেতনতার দলিল।

একসময় টুকটাক ছড়ার চর্চা আমিও করতাম, কিন্তু দেখা গেল ছড়া লেখা অত্যন্ত কঠিন। আমার পক্ষে এই চর্চা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কাঙ্ক্ষিত মানের ছড়া লিখতে না পারায় খান্ত দিতে হলো। তবু মাঝেমধ্যে পুরনো প্রেমিকার মতো হলদে হয়ে যাওয়া খাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টাই। বুক ভেঙে অক্ষমতার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তবু, ছড়ার প্রতি ভালোবাসা কখনো ম্লান হয়নি।

যারা ছড়া লেখে, আমার কাছে তারা নমস্য ব্যক্তি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, যে ছড়া লেখে, সে ভালো কবিতাও লিখতে পারবে, কিন্তু যে কবিতা লেখে, তার পক্ষে ভালো ছড়া লেখা অনেক সময় সম্ভব নাও হতে পারে। ছড়া একদিকে সরল, আবার অন্যদিকে গভীর—এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্যই ছড়াকে অনন্য করে তোলে।

‘সত্য বলা বারণ’ সমাজ-সচেতনতার ছড়ার বই। প্রতিটি ছড়া রাজনীতি কেন্দ্রিক। রাজনৈতিক ছড়া হলে যেমন হয়, এই ছড়াগুলোও ঠিক তেমনই। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে, চাবুকের সাথে সাথে প্রতিটি ছড়া মানুষকে আশাবাদী হতে শেখায়। এই বইটি সমাজের অসঙ্গতি, দুর্নীতি, এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বক্তব্য রাখে।

ভণ্ড রাজনৈতিক, ভণ্ড ধার্মিক, ভণ্ড সমাজসেবক কিংবা সাম্প্রতিক আন্দোলনে প্রথম সারিতে চলে আসা তথাকথিত সমন্বয়ক—সবাই তার ছড়ায় ভয়ংকরভাবে ধরা খেয়েছে। ছড়াগুলোর প্রতিটি শব্দ যেন চাবুকের মতো পড়ে তাদের ওপর।

আমি কোনো ছড়ার উদ্ধৃতি দিতে চাচ্ছি না, কারণ আমি চাই আপনারা বইটি সংগ্রহ করে পড়ুন। শুধু বইয়ের ২৯ পৃষ্ঠায় ‘আজকের সংবাদপত্র’ শিরোনামে একটি ছড়ার সামান্য ব্যাখ্যা দিতে চাই। এই ছড়াটি সমাজের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী এই ছড়ায় সরকার, বিরোধী দল, এবং সংবাদপত্রের ত্রিমুখী অসঙ্গতিকে রূপক আকারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এখানে “রক্তের বদলে বাঁশ”, “শ্মশানে এম্বুলেন্স”, “বিরোধীরা ভাল কাজে পিশপিশিয়ে হাসে”—এই লাইনগুলোতে তীক্ষ্ণভাবে সমালোচনা করা হয়েছে।


বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ছড়াটি সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি সরাসরি কোনো পক্ষপাতিত্ব না করেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ বা ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া। একইসাথে, এটি বিরোধীদলকেও খোঁচা দিয়ে তাদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছে।

এই ধরনের ছড়া গণমানুষের মনের ক্ষোভকে প্রভাবিত করতে পারে এবং মানুষকে রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যখন নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এই ছড়ার চোখে মানুষ সমাজের বাস্তবতা দেখতে পারে। যদি এই ছড়ায় সমাজের অসঙ্গতি প্রতিফলিত হয়, তবে তা গভীরতর উপলব্ধি এনে দিতে সক্ষম। এটি আমাদের দেশের জন্য একটি দর্পণস্বরূপ।

এই বইয়ের প্রতিটি ছড়া তীব্র ব্যঙ্গাত্মক এবং রাজনৈতিক সচেতন, তবে একটুও আশাহীন নয়। ধ্বংসের পরেও মানুষ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষ খড়কুটো ধরে শেষ পর্যন্ত বাঁচার চেষ্টা করে।


লুৎফুর রহমানের ‘সত্য বলা বারণ’ বইটি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক সংগ্রাম। আমাদের পৃথিবী পোকামাকড় দখল করবে, আমরা তা মেনে নিতে পারি না। মানুষের পৃথিবী মানুষেরই থাকবে। সত্য আমাদের বলতেই হবে। কেউ আমাদের মুখ চেপে ধরতে পারবে না। যত বেশি চেপে ধরার চেষ্টা হবে, তত জোরে আওয়াজ বের হবে।

প্রিয় পাঠক, ‘সত্য বলা বারণ’ পাঠ করে সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ থাকুন। কোনো নিষেধ মানার প্রয়োজন নেই। আমরা বলবই, কোনো বারণ মানবো না।

আমি চাচ্ছিলাম আপনাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ রেখে দেবো। কিন্তু ভাবলাম হয়তো অনেকেই আমার লেখায় প্রভাবিত হবেন না। তাই জানিয়ে দেই—এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন ছড়া সাহিত্যের আরেক দিকপাল আমীরুল ইসলাম। তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। যারা জানেন, তাঁরা জানেন, আর যারা জানেন না, তাঁদের অবশ্যই জানা উচিত।

সত্য বলা বারণ
লুৎফুর রহমান
প্রতিভা প্রকাশ, ঢাকা।