সংসারের অভাব দূর করতে প্রবাসে গিয়ে লাশ হলেন কিশোরী
লুৎফুর রহমান লুৎফুর রহমান
সম্পাদক ও সিইও, বায়ান্ন টিভি
ভালো বেতনের লোভে সংসারের অভাব দূর করতে কিশোরী উম্মে কুলসুমকে (১৪) সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। বেতনের পরিবর্তে কপালে জোটে মালিকের যৌন নির্যাতন ও মারধর। ওই দেশের হাসপাতালেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে কিশোরী কুলসুম। অবশেষে লাশ হয়ে দেশে ফিরল সেই কিশোরী।
কিশোরী কুলসুম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের মেয়ে। শুক্রবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শনিবার দুপুরে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। পরে তা স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মঙ্গলবার সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার সনদ অনুযায়ী কিশোরী কুলসুমের জন্ম তারিখ ২০০৬ সালে ২৪ ডিসেম্বর। অথচ বিদেশ যাওয়ার জন্য গোকর্ণ ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত হাসান খান ও ইউপি সচিব আবেদুর রহমানের সহযোগিতায় ১৯৯৩ সালের ১৩ মার্চ জন্মতারিখ দেখানো হয়।
পাসপোর্ট করার জন্য দেয়া ইউনিয়ন পরিষদের জন্মনিবন্ধন অনুসারে তার বয়স ২৭ বছর। কিন্তু তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সনদ অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ১৪ বছর।
গত মাসের ১৭ আগস্ট জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে কিশোরীর বাবা মেয়ের লাশ ও আট মাসের বকেয়া বেতন ফেরত পেতে একটি লিখিত দেন।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় দালাল রাজ্জাক মিয়ার মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ১৭ মাস পূর্বে মেসার্স এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (আর এল নং-১১৬৬) মাধ্যমে কুলসুমকে গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরব পাঠানো হয়। সেখানে গৃহকর্মী হিসেবে যোগদানের পর থেকেই কুলসুমের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন শুরু করে মালিকপক্ষ।
নির্যাতনের কারণে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গত চার মাস পূর্বে গৃহকর্তা ও তার ছেলে মিলে কুলসুমের দুই হাঁটু, কোমর ও পা ভেঙে দেয়। এর কিছুদিন পর একটি চোখ নষ্ট করে রাস্তায় ফেলে দেয়।
পরে সৌদি আরবের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে কিং ফয়সাল হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ৯ আগস্ট কুলসুম মারা যায়।
গত ২৪ জুন নাসিরনগর থানায় কিশোরীর মা নাছিমা বেগম একটি সাধারণ ডায়রি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ভালো কোম্পানিতে কাজ দেয়ার কথা বলে কুলসুমকে সৌদি আরবে নিয়ে গৃহকর্মীর কাজ দেয়া হয়। সেখানে নিয়মিত বেতন না দিয়ে তাকে গৃহকর্তা যৌন নির্যাতন করত।
এর প্রতিকার চাইতে গেলে দালাল রাজ্জাক মিয়া কিশোরী গৃহকর্মী উম্মে কুলসুমকে গুম করার হুমকি দেয়। পুলিশের কাছে বারবার গিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি তার পরিবার।
কুলসুমের মা নাছিমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর বিষয়টি আসামিকে ডেকে বলে দেয় পুলিশ।
তিনি বলেন, মেয়েকে যে সৌদি আরবে নির্যাতন করা হয়েছে সেটা পুলিশ বিশ্বাস করতে চায় না। নির্যাতনের ভিডিও দেখালেও তারা বিশ্বাস করেনি। দালালকে ধরতে বললে পুলিশ উল্টো আমার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় আমাকে থানা থেকে বের করে দেয় পুলিশ। সালিশে লোকজন আমাকে মারতে আসে।
ইউপি সচিব আবিদুর রহমান বলেন, কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জন্মনিবন্ধন দেয়া হয়। বিষয়টি আমি খোঁজ নেব।
স্থানীয় গোকর্ণ ইউপি চেয়ারম্যান ছোয়াব আহমেদ বলেন, ওই সময় আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না। লাশ আসার পর দাফনের জন্য পুলিশকে জানিয়ে ছিলাম।
নাসিরনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেন জানান কিশোরী উম্মে কুলুসমের মায়ের করা সাধারণ ডায়েরিটি আগেই আমলে নিয়ে আদালতে প্রসিকিউশন পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে নাসিরনগর থানার ওসি আরিচুল হক সাংবাদিকদের জানান, দুই দেশের বিষয় হওয়ায় নাসিরনগর থানা পুলিশের পক্ষে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কোনো ধরনের নির্দেশনা পাইনি। তাই আপাতত আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।