স্মৃতিতে লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে আগুন তান্ডবের ৩য় বার্ষিকী

নজরুল ইসলাম নজরুল ইসলাম

কলামিস্ট, লন্ডন

প্রকাশিত: ৩:০৮ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০২০ 508 views
শেয়ার করুন

যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট লন্ডনের গ্রীনফিল্ড বিল্ডিংটি আমার বাসা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। বিল্ডিং এর পাশ বেয়ে ড্রাইভ করে প্রতিদিন আমাকে অফিসে যেতে হয়। দূর্ঘটনার দিন সকালে ৬:৩০ মিনিটে আমি যখন বিল্ডিংপাশ বয়ে ড্রাইভ করছিলাম, লক্ষ্য করেছি আগুনের লেলিহান শিখা ,ভাবিনি এতটা ভয়ঙ্কর রূপ নিবে। অফিসে গিয়েই বিবিসি নিউজে আগুনের তান্ডব খেলা দেখে বার বারই মনে পড়ছিল ওয়েস্ট লন্ডনে তো বেশ বাংলাদেশি পরিবারের বসবাস। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে অফিস করেছি, হেড অফ ফায়ার মেট্র :পুলিশ আফিসারদের ফায়ার ইন্সিডেন্ট আপডেইট রিপোর্ট দেখে দেখেই সারা দিনই চলে গেলো। আগুন তো নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা, আগুন এর প্রচন্ডতা ভয়াবহতা শুধূ শুধুই বৃদ্বি পাচ্ছে। হেড অফ ফায়ার অফিসার বলেছেন, চাকুরি জীবনে এই ধরণের দুর্ঘটনা দেখেন নাই। এত আধুনিক টেকনোলজি থাকার পর ও ফায়ার নিয়ন্ত্রণ কেন সম্ভব হয়নি সেটাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।

আমি অফিস শেযে বাসায় না ফিরে আগুনে ভংশীভূত গ্রেনফেল টাওয়ারে স্বজন সর্বস্ব হারানো প্রতিবেশী ও হোমলেস পরিবার গুলোকে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথমেই আমার গাড়িতে বাঁধা ,আমাকে স্টপ করে পুলিশ অফিসার বলছেন যেতে পারবনা। পুলিশ অফিসারকে বললাম টাওয়ারের ১৭ তলায় ১৪৪ নং ফ্ল্যাটে আমার প্রতিবেশী নিখোঁজ আমাকে যেতে দিলে খুশী হব। পুলিশ অফিসার আমাকে অন্য কোন প্রশ্ন না করে যেতে দেন। সেখানে গিয়ে নিজ চোঁখে মানবপ্রেম ও মানবতার এক উজ্জ্বল দৃশ্য/ দৃষ্টান্ত নিজ চোখে দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে মানবতার সংজ্ঞাকে নতুন ভাবে আবারও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সাদা, কালো ,ব্রাউন, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই হয়েছেন একাকার,বাড়িয়েছেন সাহায্যের হাত। একটি (Shelter) সেল্টারে কার ভ্যান ও লরি দিয়ে সর্বশঃ হারানো মানুষের জন্য নিত্য প্রয়োজনী সামগ্রী নিয়ে আসছে ব্যাক্তি বিশেষ, চ্যারিটি সংগঠন ,ইংলেন্ডের সুপারমার্কেট গুলো। বিশাল একটি ভোলেন্টারি গ্রূপ দ্রব্যসামগ্রী আনলোড করছে। অন্য একটি গ্রূপ সে গুলো শ্রীনি বিন্যাস করে প্যাকিং করছে। প্যাকেজের গাঁয়ে মার্ক কলম দিয়ে লিখে রাখছে বক্সের মধ্যে কি আছে l সাতে সাতে বিভিন্ন স্টোর সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যা পরবর্তীতে ব্যবহার করা হবে।

আমি নিজেকে বিশিষ্ট সমাজ সেবক দাবি না করলেও সমাজ ও মানুষের কল্যান নিহিতি সমাজের প্রতিটি ভাল কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার লোভ কখনো সামাল দিতে পারিনি। প্যাকিং লোডিং আনলোডিংয়ের কাজে লেগে গেলাম। টানা তিন ঘণ্টার ও বেশি সময় কাজ করলাম কয়েকদিন অফিসে শেষে বাসায় না ফিরে। রোজা মাসেও নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়নি। সেল্টার এক এক ভদ্রমহিলা তিনির স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে স্কুল থেকে সরাসরি নিয়ে এসেছেন একটু সাহায্য করবেন বলে। আমাকে জিজ্ঞেস করছেন তিনি কি করতে পারেন ? বললাম আপনার মন যা চায় তাই করেন। ছোট বাচ্চাকে পাশে বসিয়ে প্যাকিংয়ের কাজে লেগে গেলেন। মানব প্রেমের এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তকে আপনারদের সাথে শেয়ার করার জন্য পাশে বসা ছোট ছেলেকে দিয়ে কিছু ফটো তূলার অনুরোধ করলাম যা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আমি মনে করি, আমাদের সকলেরই স্বার্থে সংশ্লিষ্টতার উপর ওঠে দেশ প্রেম,মানব প্রেম ও মানবতাবোধকে আরো জাগ্রত করা উচিৎ জাতীয় স্বার্থে।

যুক্তরাজ্য একটি মাল্টিকালচারাল দেশ, ডাইভার্স কমিনিটি। এখানে আমাদের মত এক জন বাড়িতে অন্য জন বেড়াতে না গেলেও বা পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর সাথে হ্যায় হ্যালো সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু না থাকলেও জাতীয় ইস্যু ,স্থানিয় ইস্যু ,কমিনিটি ইস্যু দেশ ও দশের কল্যান নিহিত বিষয়ে সবাই চলে আসে একি প্লাটফর্মে। জাতীয় সমস্যা নিয়ে এখানে রাজনীতি নেই বললেই চলে। তিন বছর পূর্তিতে হতাহত সবার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে আমাদের মৌলভীবাজারের নিহত পরিবারের জন্য জন্য শোক সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার নেই। বাঙালি কমিনিটি বাকরুদ্ব। একটি প্রতিবেদন রিপোর্টে দেখছি পরিবারের সদস্যের সাথে বিল্ডিঙে আটকে পড়া মৌলিভিবাজারের ছোট বোনটির কথা হয়েছে। তিনির আকুতি, আটকে পড়ার বিবরণ ক্ষমা ও দোয়া প্রার্থনা চেয়েছিলেন এই বলে যে, আমরা তো মারা যাব আমাদের যাতে বেশী কষ্ট না হয় দোয়া করবেন। আমরা বাথরুমের ভিতরে চলে যাচ্ছি।

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। এই দুনিয়াতে আমরা বড়ই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের চারদিকে একটা খাই খাই অবস্থা। দুর্ঘটনায় মৃত ,জীবিত, নিখোঁজ সকলের জন্য দোয়া করছি স্ব স্ব স্থানে তারা যেন ভালো থাকেন। দোয়া করছি আল্লাহ যেন তাঁদের বেহেস্তের সর্বোচ্চ প্রসংশিত স্থানে সম্মানিত করেন,আমিন।

নজরুল ইসলাম ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম। nazrul.islam@rmh.nhs.uk