ফয়ছল চৌধুরী এমবিই : প্রবাসে আলোকিত জন

প্রকাশিত: ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২২ 492 views
শেয়ার করুন

স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম আইনপ্রণেতা ফয়ছল চৌধুরী এমবিই। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার লোদিয়ান নামক আসন থেকে স্কটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন ফয়ছল চৌধুরী। তার এই জয় গ্রেট ব্রিটেনে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটিকে আরও দৃঢ়ভাবে শক্ত করে তুলবে। পাশাপাশি তার বিজয় একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন নিয়ে আসতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা।

ফয়ছল হোসেন চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার বদরদি গ্রামে। তার বাবার নাম গোলাম রব্বানী চৌধুরী এবং মাতার নাম রোকেয়া চৌধুরী। ফয়ছল হোসেন মা বাবার সাথে তরুণ বয়সে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। পরিবারের সাথে প্রথমে ম্যানচেস্টার এবং পরে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় বসবাস শুরু করেন। তিনি এডিনবরা শহরের নিউ টাউন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় ছেলে হিসেবে তরুণ বয়সেই তিনি পরিবারের হাল ধরেন। আর সে সময় থেকেই তিনি যুক্ত রয়েছেন পারিবারিক ক্যাটারিং ব্যবসায়।

ফয়ছল চৌধুরী ব্যবসার পাশাপাশি পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তরুণ বয়সেই শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির হয়ে এডিনবরা সাউথ ইস্ট আসনে লড়াই করেন ফয়ছল চৌধুরী। এর আগে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রশ্নে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডে গণভোটের সময় ‘বাংলাদেশিজ ফর বেটার টুগেদার ক্যাম্পেইন’ এর সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি। মূলধারার রাজনীতিতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের যুক্ত করতে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

একজন নিষ্ঠাবান সমাজসেবক ও জনহিতৈষী হওয়ার পেছনে মূলত তাঁর মামা ড. ওয়ালী তসর উদ্দিনের বেশ ভূমিকা রয়েছে। তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিটি ওয়ার্কের হাতেখড়ি হয়। দীর্ঘদিন ধরে এডিনবরা অ্যান্ড লোদিয়ান রিজিওন্যাল ইকুয়্যালিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়াও বিভিন্ন সংখ্যালঘু কমিউনিটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নেও ভূমিকা রয়েছে তার।

ফয়ছল চৌধুরী একজন জনদরদি এবং পরম পরোপকারী ব্যক্তিত্ব। মানুষের বিপদে-আপদে তিনি সবসময় পাশে দাঁড়ান। এ সময় তিনি ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বলয় ভেঙ্গে সর্বস্তরের মানুষকে সেবা প্রদান করেন। তাই দেখা যায়, করোনা মহামারিতে এডিনবরায় বসবাসরত অভাবগ্রস্ত এথনিক মাইনরিটি পরিবারগুলোর মধ্যেও খাদ্যদ্রব্য বিতরণের এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ হাতে নেন তিনি। তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে এলরেক এর উদ্যোগে ‘ফুড সাপোর্ট’ প্রকল্পের আওতায় প্রতি সপ্তাহে ৩০টি অসহায় পরিবারকে জরুরি খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। তার এই কাজ স্থানীয় কমিউনিটিতে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এভাবেই নানাভাবে সমাজসেবা করে তিনি মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন।

একজন সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন। যা তাকে স্কটল্যান্ডের জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণে অনুপ্রাণিত করে। তাই তো ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে প্রথমবারের মতো তিনি স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টে জয়ী হন। একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে ফয়ছল চৌধুরী অনন্য সম্মান অর্জন করেন। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার একটি আসন থেকে স্কটিশ লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন ফয়ছল। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এসএনপি পায় ৬৪টি আসন, কনজারভেটিভ পার্টি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১টি আসন এবং ২২টি আসন পেয়ে নির্বাচনে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে ফয়ছল চৌধুরীর দল স্কটিশ লেবার পার্টি। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে চালু হওয়া এই পার্লামেন্টে মূলত-স্কটিশ জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ট্রান্সপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাছাড়া কয়েক প্রকার পাবলিক বেনিফিট এবং ট্যাক্স সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করার ক্ষমতাও রয়েছে স্কটিশ পার্লামেন্টের। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১২৯ জন এমএসপি (মেম্বার অব স্কটিশ পার্লামেন্ট) নির্বাচিত হন। সেখানে ফয়ছল চৌধুরীর বিজয় যেন পুরো বাংলা ভাষা-ভাষীদের বিজয়।

ফয়ছল চৌধুরী গ্রেট ব্রিটেনে মূলধারার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটিকে যুক্ত করতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি স্কটিশ মূলধারার নানাবিধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। তিনি ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি স্কটল্যান্ডের চেয়ার, এডিনবরা স্লেভারি অ্যান্ড কলোনিয়াল লেগাসী রিভিউ গ্রুপের সদস্য, মিউজিয়াম অ্যান্ড গ্যালারিস স্কটল্যান্ডের বোর্ড মেম্বার, ইএসএমএসের ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডাইভার্সিটি টাস্ক ফোর্সের অ্যাডভাইজার এবং ড্রামন্ড হাই স্কুল প্যারেন্ট কাউন্সিলের সদস্য হিসেবেও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম মাল্টিকালচারাল আয়োজন ‘এডিনবরা মেলা’র প্রতিষ্ঠাকালীন ও বর্তমান ডিরেক্টর ফয়ছল চৌধুরী গিল্ড অব বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টার ইন স্কটল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সমিতি এডিনবরার চেয়ারম্যান, কাউন্সিল অব বাংলাদেশিজ ইন স্কটল্যান্ডের (সিবিএস) সাধারণ সম্পাদক এবং যুক্তরাজ্য নবীগঞ্জ এডুকেশন ট্রাস্টের ট্রাস্টি মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সাইক্লোন আপিল এবং ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সাইক্লোন সিডর আপিলে তিনি তহবিল সংগ্রহ ছাড়াও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘সেন্ট কলম্বাস হসপাইস’, লিউকেমিয়া ও ক্যান্সার আপিলসহ ‘ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন’-এর জন্য তহবিল সংগ্ররহন জন্য কাজ করেছেন।

ফয়ছল চৌধুরী স্কটিশ মূলধারায় বাংলাদেশি কমিউনিটির ভাবমূর্তি তুলে ধরতে সদা তৎপর থাকেন। তার নেতৃত্বে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মত স্কটল্যান্ডে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়, যার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল সিটি অব এডিনবরা কাউন্সিল। এ উপলক্ষে সেদিন স্কটিশ পার্লামেন্টে একটি পার্লামেন্টারি মোশনও উত্থাপন করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ সমিতির উদ্যোগে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস যেন একটি গৌরবান্বিত অধ্যায় সূচিত করলো।

ফয়ছল চৌধুরী তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের রাণী কর্তৃক সম্মানসূচক ‘মেম্বার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার’ (এমবিই) খেতাবে ভূষিত হন । এছাড়া ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বাংলাদেশি টেলিভিশন ‘চ্যানেল এস’ কর্তৃক ‘কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ নানা পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে।

ফয়ছল চৌধুরী প্রবাসের মাটিতে বসেও যেভাবে দেশ এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করছেন, তা সত্যিই বিরল। একজন রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক হিসেবে তিনি যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাতে তিনি সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেবেন। প্রবাসের মাটিতে ফয়ছল চৌধুরী সমাজকল্যাণের এক মূর্ত প্রতীক। তাঁর মতো মানুষদের দ্বারাই সমাজে পরিবর্তন সূচিত হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।