২১ আগস্ট বাংলাদেশের মানুষের কান্নার দিন

তিশা সেন তিশা সেন

বার্তা সম্পাদক, বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ৬:২৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২১, ২০২০ 642 views
শেয়ার করুন

 

তারিখ : ২১ আগস্ট, ২০০৪

স্থান : বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা, বাংলাদেশ

লক্ষ্য : ৭ আগস্ট সিলেট বোমা হামলার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে

হামলার ধরন : গ্রেনেড হামলা

নিহত : ২৪

আহত : ৩০০+

সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদের ফলস্বরূপ আরো একটি হামলা। উপরের সকল তথ্য গুলি কত সহজ করেই না উইকিপিডিয়া তুলে ধরেছে কিন্তু আদৌ কি সেদিনটা এত সহজ ছিল?

মোটেও নয়। এ কথা কেন বলছি, আমার লেখাটি পড়লে একটু পর বুঝতে পারবেন।

গ্রেনেড এক প্রকারের নিক্ষেপণযোগ্য বোমা। অধিকাংশ গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরে চারিদিকে ছররা বা ধাতুর টুকরো বা শার্পনেল অতি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এবার জানুন গ্রেনেডের বৈশিষ্ট্য :

* মারণক্ষমতা সুনির্দিষ্ট কিন্তু ক্ষুদ্র এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। (৫ মিটার ব্যাসার্ধের এলাকা)

* আহত করার দূরত্ব বেশ বড়, প্রায় ১৫ মিটার দূরত্বের মধ্যে থাকা ব্যক্তিদের আহত করতে পারে।

* ফিউজ খুলে নিক্ষেপের পরে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুটা সময় হাতে পাওয়া যায় ফলে নিক্ষেপকারী নিরাপদে থাকেন।

গ্রেনেড বিষয়ে এই তাত্ত্বিক অংশটি পড়া শেষে, আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন এত কিছু বলার কারণ কি?

গ্রেনেডের মারণক্ষমতার যে সুনির্দিষ্ট ৫ মিটার ব্যাসার্ধের এলাকা থেকে দূরে যাওয়ার, আহত করার ক্ষমতা রাখা প্রায় ১৫ মিটার দূরত্বের এলাকার গন্ডি পার হ‌ওয়ার, এবং নিক্ষেপ করা গ্রেনেড দেখে পালিয়ে যাওয়ার মতো সময় বা সুযোগ, কোনোটাই ছিলো না।

আসলেই কি ব্যাপারটা শুধু এটুকু? না। লক্ষ্য প্রতিবাদ সমাবেশ হলেও উদ্দেশ্য ছিল নেত্রীকে হত্যা করা। দ্বিতীয়বারের মতো জাতিকে পঙ্গু করে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। যে সাপের লেজে পা দেওয়া হয়, সে সাপ যদি ফোঁস করে ওঠে, তার মাথা থেঁতলে দেয়ার চেষ্টাই প্রথমে করে মানুষ। তবে মানুষের মনে রাখা উচিত, সাপ কখনো নিজ থেকেই ছোবল মারতে আসে না, তারাও নিরিহ একটি প্রাণী যারা বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছে।

সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে বিকেল পাঁচটায় পৌঁছালে, একটি ট্রাকের উপর তৈরি মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র ‘দেড় মিনিটের’ মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১ টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।

৯০ সেকেন্ডে ১১টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ। একটা পটকা বাজির আওয়াজে মানুষ একটু ভয় পেয়ে যায়, তাহলে ভেবে দেখুন সেই এগারটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে, কতোটুকু আতঙ্ক আর ভয় গ্রাস করেছিল সেই সকল মনকে যারা সেইদিন সমাবেশে বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় উপস্থিত ছিলেন। নিহত ২৪ জন ছাড়াও তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ ৩০০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই হারিয়েছে হাত-পা বা চোখ। আর নিহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯ তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী।

আজ সেই একই তারিখ। হয়তো ক্যালেন্ডারের পাতার সাথে, বছর পাল্টেছে। সরকার ও ক্ষমতা পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে দেশের অবস্থাও। শুধু হয়তো পাল্টাতে পারেনি সেই দিন উপস্থিত সকল মানুষের মন। এইদিনটির কথা ভাবলে লাগে, আজ‌ও হয়তো তারা চোখ বুঝলে শুনতে পাই গ্রেনেডের আওয়াজ, দেখতে পাই সকল প্রিয়জনদের আতঙ্কে ভরা চোখ-মুখ, কানে শুনতে পায় সে একমুহূর্তের চিৎকার, এবং পরবর্তী মুহুর্তের সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। অনেকের শরীরে থাকা সকল শার্পনেল অপারেশনের মাধ্যমে হয়তো বের করা সম্ভব হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের স্মৃতিতে গেঁথে যাওয়া শার্পনেল গুলো থেকেই যাবে।

নতুন প্রজন্মের উচিত ইতিহাস কে জেনে রাখা এবং মনে রাখা। এই অমানবিক কাজে যারা লিপ্ত ছিলেন, যারা এমন চিন্তাধারা বহণ করেন, তাদের চিনে রাখা।

সেইদিন শুধু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নয়, আওয়ামী লীগ কর্মীও নয়, অনেক সাধারণ মানুষ‌ও আহত বা নিহত হয়েছেন। যে মানুষের চিন্তা করে নি, সে কোন দিন যে বাংলাদেশের ভালো করতে পারবে, আমার বিশ্বাস হয় নি। আমার কি, প্র্যাক্টিকাল মাইন্ডের কোন মানুষ‌ই এই কথা মানবে না।

আর জাতির জনকের করা সকল কাজের উদাহরণের মাধ্যমে, আমাদের বোঝা উচিৎ, এই দেশটি চিরজাগ্রত। ক্ষণিকের জন্য থামানো গেলেও, পথচলাটা চিরতরের জন্য থামানো অসম্ভব। সঠিক নেতৃত্ব ফিরে-ফিরে আসবে, এবং দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেই। এই পথচলায়, হারিয়ে গেছে অনেকে, তাদের অবদান মনে রাখতে হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত সকলের ও তাদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং নেত্রীকে সেইদিন যারা সুরক্ষিত রেখেছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ বার্তা সম্পাদক, বায়ান্ন টিভি