চিরদিনের ‘মেয়র কামরান’

প্রকাশিত: ১২:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০ 781 views
শেয়ার করুন

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সিলেটবাসীর প্রিয় নাম। এরকম একটি শ্লোগান সবার মুখে মুখে। কিন্তু এখন সিলেটের গন্ডী পেরিয়ে গোটা দেশে এই নামটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে। দেশের প্রথিতযশা মানুষদের কাছেও তিনি সমাদৃত। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর সর্বশেষ ‘দিনদিন প্রতিদিন’ শিরোনামের একটি পাক্ষিক কলামে লিখেছেন, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি সিলেটে, একজন সিলেটে থাকবে আর মেয়র কামরানের সঙ্গে পরিচয় থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। তাই মেয়র কামরানের মৃত্যুটি আমাকে বিষন্ন করে তুলেছে।

 

একটা ঘটনার কথা আমার মনে আছে, তখন বিএনপির আমল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরেরা হঠাৎ করে কাজ করা বন্ধ করে দিল, আর ঠিক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একধরনের গোলমাল শুরু হয়েছে। তখন কথা নেই বার্তা নেই পুলিশ এসে গুলি করে আমাদের একজন ছাত্রকে মেরে ফেলল। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে সঙ্গে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে, ক্ষিপ্ত ছাত্ররা এসে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সব মিলিয়ে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা। পুরো ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা, উত্তেজিত মানুষের চিৎকার, হইচই, ছোটাছুটি। তার মাঝখানে আমি আর আমার স্ত্রী ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম দুজন কম বয়সী মানুষ আমার পিছনে পিছনে হাঁটছে, আমি যেখানে যাই তারাও পিছু পিছু সেখানে যায়। আমি একসময় একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কারা? কী চান?’ তাদের একজন বলল, ‘আমাদের মেয়র কামরান পাঠিয়েছেন। এরকম গোলমালের সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। আমাদের পাঠিয়েছেন আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকার জন্য, যেন এই গোলমালের সুযোগ নিয়ে আপনাকে কেউ কিছু করতে না পারে।’ আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার জন্য তাঁর এই ভালোবাসার প্রতিদানটুকু আমি তাঁকে কেমন করে দেব?’

এই হচ্ছেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। এরকম দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণীর মুখে রয়েছে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের অবদানের কথা।

তাঁর মৃত্যুতে আমি গভীর বেদনাহত। কত স্মৃতি আজ মনে পড়ছে, তা ভাষায় রূপ দেওয়া কঠিন। কারণ যখনই ভাবি কোনো বিপদে কিংবা প্রয়োজনে পরামর্শের জন্য এই মহীরুহের কাছে আর যাওয়া যাবে না, তখনই মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়।
রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ থাকবেই। কিন্তু সেই প্রতিপক্ষ যখন কোনো ব্যক্তিকে ভিন্ন মত পোষণ করার পরও শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় আগলে রাখে, সেই জীবনের চেয়ে ধন্য জীবন আর কি আছে? আমরা প্রতিদিন নানা সঙ্কটে পড়ি। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যখন নিজের মূল্যায়ন করি, তখন মনে হয় কামরান ভাইয়ের অকৃত্রিম নীতি আদর্শ হিসেবে নিতে পারি। মূলত তিনি ছিলেন জাতির জনক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির একনিষ্ট ধারক ও বাহক। তাঁর পোশাকে, কথা বলার ধরণ, অসাধারণ বাগ্মীতা, সব কিছুতে ছিল বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া। জাতির কান্ডারি বঙ্গবন্ধু তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কামরান ভাইয়ের মৃত্যুতে নেত্রীকে ভীষণ বিষন্ন হতে দেখেছি। সংসদসহ কয়েকটি সভায় কামরান ভাইয়ের নাম নিয়ে বারবার নিজের প্রিয়জন হারাবার দুঃখ ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতন এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা সিলেটবাসীর সম্পদ ছিল। আমার বিশ্বাস, তাঁর মূল্যায়ন হবে কালে কালে। কালের ভেলায় একজন কামরান চিরস্মরণীয় থাকবেন।

রাজনীতির চলার পথ কখনই মসৃন হয় না। কামরান ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনও সহজ ছিল না। রাজনীতির জন্য তাঁকেও কারাবরণ করতে হয়েছে। ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখ থেকে বারবার ফিরে এসেছেন। এরপরও তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। ধৈর্যশীল হওয়ার যে মন্ত্র কামরান ভাই জানতেন, রাজনীতির জন্য যা সবচেয়ে বড় জরুরি বিষয়।

বদরউদ্দিন কামরান ছিলেন রাজনীতির চলমান এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর শিক্ষা ছিল চলনে, বলনে। তিনি যা বলতেন অন্তর থেকেই বলতেন। তাই তাঁর প্রতি আজ যে শ্রদ্ধা, তা অকৃত্রিম। তিনি চাইতেন কর্মীদের মধ্য থেকে নেতা উঠে আসুক। এই বোধ কয়জন নেতার মধ্যে ছিল বা আছে, ভেবে দেখা যেতে পারে। কামরান ভাইয়ের এই মহৎ গুণের পরিচয় আমরা বহুবার পেয়েছি। মেয়র থাকাকালিন বা মেয়র না থাকা অবস্থায় তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। সব সময়ই তিনি ছিলেন একজন রাজনৈতিক সাবলীল ব্যক্তিত্ব। হয়ত তাই তাঁকে জনগন ‘মেয়র কামরান’ বলে আজীবন অভিহিত করেছেন।

একটি কথা প্রচলিত ছিল যে, কেউ কোনো কাজ নিয়ে গেলে কামরান ভাই না করতেন না। না দেখেই দস্তখত দিয়ে দিতেন। কেউ কোনো তদবিরের জন্য গেলে তা পূরণ করতেন। ফোন করে তদবিরের জন্য কাজ করে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন একাধিক মানুষ তাঁর কাছে যেতেন। কিন্তু এটি ঠিক, তিনি কখনও ‘অন্যায় অনুরোধ’ রাখার জন্য কাউকে অনুরোধ করেননি। যেখানে যা বলা দরকার শুধু তা বলতেন। যা করলে মানুষের মঙ্গল হয় তা-ই করতেন।

তাঁর মতো উদার আর সম্প্রীতির রাজনীতিবিদের সংখ্যা বড় কম। দিন দিন তা কমেও আসছে। তাই একজন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আমাদের চলার পথের পাথেয়, আদর্শ প্রত্যয়।

________________________________________________

লেখক: আলহাজ্ব আফছার আজিজ, সভাপতি-সিলেট জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ