দেশের মানুষের দূর পরবাসে ঈদ কাটল কেমন

প্রকাশিত: ৪:৪৮ অপরাহ্ণ, জুন ৯, ২০২৫ 500 views
শেয়ার করুন

 

🌿

🎇প্রা ক ক থ নঃ
————————————————————-
বছর ঘুরে ফের এসে চলে গেলো ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঈদ উল আজহা। উৎসব পালা পার্বণ সবাইকে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার তাগাদা দেয়। পরিবার পরিজন আত্মীয় বান্ধবদের সান্নিধ্যে কাটানো উৎসব পায় নতুন মাত্রা। কিন্তু দূর পরবাসে যারা কর্তব্যের টানে পড়ে থাকেন,কখনো ছুটির সমস্যা,কখনো অর্থনৈতিক, কখনোবা ভিসার সমস্যা,বিমান টিকেটের উচ্চমূল্য …এসব বহুমাত্রিক সমস্যার বেড়াজালে দেশে ঈদ কাটানোর শত ইচ্ছে,সহস্র আকুতি তাদের কর্তব্যের দেয়ালে গুমরে মরে। আমরা এবারের ঈদে যারা দেশে যেতে পারেননি তাদের কাছে গেছি, সবার একটিই কথা প্রবাসে ঈদ বলে কিছু নেই,থাকতে পারে না। তবু উৎসব পার্বন বলে কথা! প্রবাসীদের নানা কথামালায়, ছড়ায় আমরা সাজিয়েছি আজকের প্রতিবেদন “দেশের মানুষের দূর পরবাসে ঈদ কাটল কেমন”।

ইফতেখার হোসেন বাবুল,আবুধাবি প্রবাসী কমিউনিটি নেতাঃ
গত ঈদুল ফিতরের মত এবারও প্রবাসে ঈদ উল আজহা উদযাপন করছি। তবে সৌভাগ্য এই যে এবারের ঈদ উল আজহা উদযাপনের জন্য আমার সহধর্মিণী এসেছে দেশ থেকে। ঈদের নামাজ পড়ে মিনায় আবুধাবি ক্যাটেল মার্কেটে গেলাম কোরবানির পশুর জন্য। এখানে আমাদের দেশের মত বাড়ি বাড়ি কোরবানির পশু জবাই করার,পরিবার পরিজনদের সবাই বসে মাংশ কাটাকুটি কিংবা আত্মীয় পরিজন,প্রতিবেশী কিংবা প্রান্তিক মানুষের মাঝে কোরবানির গোশত বিলির সুযোগ নেই। কোরবানির পশু পছন্দ করে নিয়ে স্লটার হাউজ থেকে তা জবাই করে কেবল গোশত নিয়ে আসা হয়। দিনভর দেশি বিদেশী বন্ধু,বান্ধবদের আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে কাটে আমাদের ঈদের দিন। তবু প্রবাসে ঈদের আনন্দের ঘাটতি থেকেই যায়। এখানে কারো ব্যবসার সমস্যা, কারো ভিসার সমস্যা, কারো অর্থনৈতিক সমস্যা নানা সমস্যায় দেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অনেক প্রবাসী ঈদে পার্বণে দেশে যেতে পারেন না। এটা বেদনার। বাবাকে তো আগেই হারিয়েছি,আরেক ঈদে দেশে যেয়ে মাকে পাব আর কোন নিশ্চয়তা নাই। ঈদে মাকে কদমবুচি করে দোয়া নেয়া যে কত আনন্দের ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সব প্রবাসীর মত আমারও আশা সুবিধা জনক সময়ে দেশে যাওয়ার।

 

>নাজমান নাহার বুবলি,রাস আল খাইমাহ প্রবাসী বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তাঃ
প্রবাসের ঈদ খুবই সাদামাটা। এখানে দেশের মতো ঈদের আমেজ নেই। নেই পরিবার পরিজন,পাড়া প্রতিবেশিদের সবাইকে নিয়ে ঘটা করে ঈদের আনন্দ করা। তারপরও আমরা যারা প্রবাসে থাকি চেষ্টা করি ঈদকে যতটুকু সম্ভব আনন্দময় করতে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজে যাই। এখানে মহিলাদের নামাজের সুন্দর আলাদা ব্যবস্থা আছে।সবাই মিলে ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে একটু সেমাই পায়েস খেয়ে চলে যেতে হয় গরু কোরবানি দেওয়ার জন্য। যেহেতু আমরা কয়েক পরিবার মিলে শরিক এ কোরবানি দিই তাই সবাই যে যার যার ভাগ নিয়ে বাসা চলে আসি সকাল ১০:৩০টার মধ্যে। এরপর যে যার যার পরিবার নিয়ে রান্নাবান্না করি। বাসায় খুব সীমিত মেহমান আসে তাও ব্যাচেলর।
কারণ যাদের ফ্যামিলি আছে সবাই ব্যস্ত থাকেন কাজ নিয়ে। খাওয়া-দাওয়া পর লম্বা একটা ঘুম দেই এরপর বিকেলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া হয়। এই হলো প্রবাসের ঈদ।

 

> মেহেরুন্নেছা দীপা,বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার,শারজাহ ইসলামিক ব্যাংক,আবুধাবিঃ
প্রবাসে পরিবারের সদস্যদের সবাইকে একসাথে নিয়ে খুব ভোরে ফজরের আজানের আগেই শেখ যায়েদ গ্র‍্যান্ড মস্কে ঈদের নামাজ পড়তে চলে। দেশি বিদেশীদের সাথে এককাতারে বসে নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে সুইটস ও চকোলেটের ডালা নিয়ে বাচ্চারা দাঁড়িয়ে থাকে সবার মাঝে তা বিলি করতে। দেখে ভাল লাগে। মূলতঃ এটাই এখানে ঈদের একমাত্র আনন্দ। এরপর বাসার পুরুষ সদস্যরা চলে যান কোরবানির গোশত আনতে। আর আমরা দেশে ফোনে আত্মীয় স্বজনদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে সময় কাটাই। ঈদ এলে দেশে ফেলে আসা নানা রঙের দিনগুলি মনের জানালায় উঁকি দেয়। এখন বাবা মা দুজনের কেউই নেই,যাদের সাথে কথা বলে একটু শান্তি পাব। দেশে যেতে পারলে আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা হত প্রবাসের কর্মজীবনের কারণে ইচ্ছা থাকলেও এবার দেশে ঈদ করতে যেতে পারলাম না। এই প্রবাসে ঈদ বলতে আসলে তেমন কিছু নেই।

> গিয়াস উদ্দিন, প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, আবুধাবিঃ
ছোট বেলায় ঈদের সকালে মাকে সালাম করে বাবার হাত ধরে ঈদগায় যেয়ে নামায পড়া, সবাই মিলে দাদা দাদীর কবর জিয়ারত করে একসাথে বাড়িতে ফিরে আবার মায়ের সাথে বসে সেমাই খাওয়া, এরপর কার আগে কার কোরবানির গরু জবাই দেয়া যায় তার প্রতিযোগিতা, সবাই মিলে মাংশ কোটা,ঘরে ঘরে মাংশ বিলি এসবের কিছুই এখানে নেই তাই আমাদের প্রবাসের ঈদ কাটে বন্ধুদের সাথে ঈদের নামাজ পড়ে,হোটেলে গোশত পরাটা খেয়ে। এরপর সবার চলে লম্বা ঘুম। আগের দিন গভীর রাত অবধি আড্ডাবাজিতে ঘুমের ঘাটতি পূরণ ছাড়াও পরবাসে পরিবার পরিজন ছাড়া ঈদ করার কষ্ট ভুলতেই প্রবাসের ঘরে ঘরে চলে এই ঘুমের নিঠুর আয়োজন।

>> লুৎফুর রহমান,প্রবাসী সাংবাদিক,ছড়াকার,দুবাইঃ
ঈদ ছিল ছেলেবেলার সুখের। বাবা মা ভাই বোন সবার মাঝেকার ঈদ। এরপর যেন দিনের পিঠে আমরা বড় হতে থাকি। দায়িত্ব বাড়ে। হয়ে যাই প্রবাসি।
নিজের লেখা ছড়ার ভাষায় এভাবেই বর্ণনা করা চলে প্রবাসীর ঈদকেঃ

পরবাসীদের ঈদ মানে তো দেশে টাকা দেওয়া

কেমন আছেন ফুপি, খালা ফোনে খবর নেওয়া।

ঈদের দিনটা ঘুমিয়ে কাটে কিংবা কারো কাজে

কারো আবার চোখ ঘড়িতে বেলা ক’টা বাজে?

ঈদের দিনে পায় না ওরা বুকে বাবার বুক

লুকিয়ে কাঁদে কেউ তো আবার মুছে নিজের চোখ।

মায়ের হাতের পায় না পায়েস ঈদ সকালের সেমাই

কইতে না পায় অবুঝ খোকা আনিয়া মোরে দে মাই”।

মায়ের হাতের রান্না কেবল রান্না তো নয় ভাই

মায়ের সকল মমতা যে ওই পায়েসে পাই।

দেশের লাগি দেশান্তরি সান্ত্বনা স্রেফ একি

‘সুখে আছি’ বলে সবাই সত্যি এসব মেকি।

মনটা যদি লাশ হয়ে যায় শরীরটা হয় মোটা

ওই জীবনে হয় কি বলো সুখের গোলাপ ফোটা?

তবুও ওরা ভালো আছে সবাই ভালো বলে

কারণ নিজের ঘামের লাগি অনেক পরান চলে।

দেয়ার মাঝে সুখটা যে পাই ফিলিংসটা হয় নাইস

সব প্রবাসীর মন হয়ে যায় ফ্রিজের ওই আইস।

> প্রিয়াংকা খন্দকার, গৃহিণী, ব্লগার,আবুধাবিঃ
প্রবাসে ঈদের দিনে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে অনেক বেশি মিস করি। ছোটবেলা থেকে ভাইবোনদের নিয়ে একসাথে বেড়ে ওঠা এবং বিশেষ দিনগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো প্রবাসের বুকে বড্ড বেশি নাড়া দেয়।
তবু কিছুটা স্বান্তনা এই যে এখানে আবুধাবিতে আমার স্বামী সন্তান,ননদ,ভাসুর,জা, ভাতিজা,ভাতিজী, ভাগ্নাদের মানে আত্মীয় স্বজনদের একটা বড় বহর আছে। সবাই মিলে ঈদের নামাজ পড়তে যাই,কোরবানি দিই,একসাথে রান্নাবাড়া করি, দিনভর মেহমানদের আপ্যায়ন করি। ঈদের দিন ব্যস্ততায় কাটলেও ঈদের পরদিন আমরা লং ড্রাইভে কোথাও চলে যাই। ঘুরে ফিরে হোটেলে রাত্রিযাপন করে ফিরি পরদিন। এরপর আবারো শুরু হয় কর্মব্যস্ততা, বাচ্চাদের পড়াশোনা।
ঈদে প্রত্যাশা ভালো থাকুক প্রিয় মাতৃভূমি ও প্রবাসের সবাই।

> ফরহাদ হোসাইন,জনসংযোগ কর্মকর্তা, কাতার দূতাবাস আবুধাবিঃ বিবর্ণ ঈদ কাটাচ্ছি
প্রবাসে নিরুপায় হয়ে। নিঃস্ব রিক্ত হয়ে দূর পরবাসে ঈদ উদযাপন আমাদের যেন এক রকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এবারের ঈদ আমার বেদনার বিবর্ণ পূরাণ হতে চলেছে।গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মানুষের ঈদের উচ্ছ্বাস উপভোগ করার জন্য মনটা তৃষ্ণার্ত ছিল। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোরবানির ঈদ করার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা নিয়ে দিনক্ষণ গুনছি,গোছাগুছিও শেষ কিন্ত তকদীরে হয়তো দেশ সেভাবে লেখা হয়নি। কাতার হতে আমিরাতে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি সফরকে ঘিরে আমার ছুটি শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হল। সে কষ্ট প্রকাশের ভাষা এই অসহায় প্রবাসির নেই। ভিনদেশী দূতাবাসে কাজ করি, তাদের কাছে আবেগ তুচ্ছ, মুখ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব পালন।

>> মাহবুব খন্দকার, সাধারণ সম্পাদক, যশোর জেলা কল্যাণ সমিতি,ইউএইঃ
ঈদ যায় ঈদ আসে
স্মৃতির পাতায় দেশ ভাসে……
বিশ্বের নিরাপদতম দেশে থাকি তারপরও প্রতিবার ঈদ এলে মনটা দুমড়েমুচড়ে যায়-দেশে প্রিয় জনদের সাথে ঈদ করতে না পারার বেদনায়। তবু পরিবার পরিজন নিয়ে যখন প্রবাসে আছি তাদের মুখের দিকে চেয়ে ঈদের আয়োজন করতে হয়। তবে স্বান্তনা এখানে বড় ভাই ভাবী আছেন এই প্রবাসে, বাবা মার অনুপস্থিতিতে তাঁরা আমার অভিভাবক। আত্মীয় স্বজনদের সাথে কোরবানি দিই। বন্ধু বান্ধবরা আসেন,কোম্পানির ওয়ার্কার, আমার সংগঠনের সদস্যরা আসেন,তাদের আপ্যায়নে কেটে যায় আমাদের দিন। ঈদে বাড়ি গেলে সবার সাথে সবার সাক্ষাতের দূর্লভ মুহূর্তগুলো ভীষণ মিস করি দূর পরবাস থেকে।