হারিয়ে যাচ্ছে সার্কাস-যাত্রাপালা!

১৫০০ হলের মধ্যে সচল মাত্র ৬০টি * ৩০০ যাত্রাদলের ১২-১৫টি নামেমাত্র সক্রিয় * অর্ধশতাধিক সার্কাস দলের মধ্যে বর্তমানে আছে মাত্র ৩-৪টি

লুৎফুর রহমান লুৎফুর রহমান

সম্পাদক ও সিইও, বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ১০:২৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১ 373 views
শেয়ার করুন

 

একটাই কথা আছে বাংলাতে/ মুখ আর বুক বলে একসাথে/ সে হল বন্ধু, বন্ধু আমার…। নায়ক জাফর ইকবাল-ফারুক অভিনীত ‘বন্ধু আমার’ ছবির এ গান মানুষের হৃদয় জয় করেছে। আশির দশকের এ ছবিটি দেখার জন্য ‘মায়াবী’ সিনেমা হলের সামনে উপচে পড়েছিল মানুষ। টিনশেডের সেই হলে সারি সারি কাঠের বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি দর্শক। আর ছবি শুরুর আগেই হলের বাইরে ঝুলত ‘হাউজ ফুল’। বলছিলেন, নব্বই ঊর্ধ্ব বিমল চন্দ্র রায়। তার ভাষ্য, মায়াবী হলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ায় স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এখন বন্ধ। বন্ধ পুরো জেলার বাকি ১২টি হলও। সিনেমা হলের মতো যাত্রাপালা, পুতুলনাচ ও সার্কাসসহ বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলো এখন গভীর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

রাজধানীর কাছের নারায়ণগঞ্জ শহরেই এক সময় ১০টি সিনেমা হল ছিল। যাত্রার দল ছিল ৭টি। এখন হল আছে মাত্র একটি, আর কার্যত যাত্রার কোনো দলই নেই। দিনাজপুর শহরে ৬টি হলের মধ্যে ৫টি বন্ধ। চালু মডার্ন হলটিও বন্ধের পথে। শুধু নারায়ণগঞ্জ-দিনাজপুরই নয়, সারা দেশে প্রায় ১৫শ সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে চালু আছে মাত্র ৬০টি। আর যাত্রার দল ছিল ৩শর ওপরে। এখন নামমাত্র ১০-১২টি দল রয়েছে। তাও তাদের কোনো প্রদর্শনী নেই। অর্ধশতাধিক সার্কাস দলের মধ্যে বর্তমানে আছে মাত্র ৩-৪টি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিখ্যাত যাত্রার দলটির নাম ছিল ‘জয় দুর্গা অপেরা’ প্রায় তিন যুগ আগেই এটি বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠা ‘রূপসী’, ‘রজনীগন্ধা’ ও ‘চিত্রালয়’ হল তিনটিও বিলুপ্ত। সিনিয়র সাংবাদিক কবি ও আবৃত্তিকার আল-আমিন শাহীন বলেন, শহরের মোড়-রাস্তা আজও হলগুলোর নামেই রয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীতে ‘দেশ অপেরা’ নামে যাত্রার দল ছিল-বিখ্যাত। চট্টগ্রামের ‘বাবুল অপেরা’, ‘জিৎশ্রী যাত্রা ইউনিট’, সিরাজগঞ্জের ‘বাসন্তি অপেরা’, ময়মনসিংহের ‘নবরঞ্জন অপেরা’, সাতক্ষীরার ‘আরজ অপেরা’, ‘নিউ প্রবাস অপেরা’, মানিকগঞ্জের ‘নিউ গণেশ অপেরা’, ‘বলাকা অপেরা’, ‘চারনিক নাট্যগোষ্ঠী, যশোরের ‘প্রতিমা অপেরা’, নারায়ণগঞ্জের ‘কহিনূর অপেরা’র মতো জনপ্রিয় বিভিন্ন যাত্রাদলের পরিবেশনায় টানা যাত্রাপালা হতো। কিন্তু এখন আর সেসব নেই।

জানা গেছে, আগে পালা শিল্পীদের মূল্যায়ন ও পরিচিতিও ছিল বেশ। স্বাধীনতার আগে ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালায় অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত যাত্রা শিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাস, জ্যোৎøা বিশ্বাস, অঞ্জুশ্রী মুখার্জি, জাহানারা, রনি চক্রবর্তী, সুলতান সেলিম, হাবীব সারোয়ার, আমির সিরাজী, মুকুন্দ্র ঘোষ, অশোক ঘোষ, পূর্ণিমা, চন্দ্রা ব্যানার্জিরা। তাছাড়া স্বাধীনতার আগে ও পরে বিখ্যাত যাত্রাপালা ঈশা খাঁ, রক্তাক্ত প্রান্তর, বাংলার মহানায়কসহ শতাধিক যাত্রাপালা বিভিন্ন জেলায় প্রদর্শিত হতো। এখন যা কেবলই অতীত। এক সময় সারা দেশে অভিয়ন শিল্পী থেকে শুরু করে মঞ্চ তৈরি, মেকআপ শিল্পীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ। শিল্পীরা মঞ্চে ইতিহাসের জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠতেন।

এদিকে চিত্রনায়ক রাজ্জাক-কবরী, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, আলমগীর-শাবানা, জাফর ইকবাল-ফারুক (বন্ধু জুটি), সোহেল রানা-চম্মা জুটির ছবি মুক্তি পেলে শহর থেকে গ্রামের সব সিনেমা হলগুলো হাউজ ফুল থাকত। এখন সারা দেশে ৬০টির মতো হল রয়েছে। এক সময় প্রায় ১৫শ হল ছিল। রাজধানীতেই প্রায় শতাধিক হল ছিল- এখন মাত্র ২-৩টি রয়েছে। নাম করা হলগুলো ভেঙে বড় বড় মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন ছবি ও হল তৈরিতে সরকার সহযোগিতা করছে। একই সঙ্গে সরকার হল তৈরিতে ১ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত অনুদান দিতে চাচ্ছে কিন্তু সেই অনুদান নিতেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে যুগান্তরকে বলেন, একটি দেশের লোকসংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। মানুষ যাত্রার মাধ্যমে বিনোদন ও লোকশিক্ষা দুটোই পেত। ঐতিহ্য আর ইতিহাসনির্ভর যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতো। বিভিন্ন সময় স্থানীয় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা মাঠে কিংবা শুকনো বিলে ত্রিপল টানিয়ে যাত্রা হতো। সার্কাস হতো। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বিনা টিকিটের সেই সব যাত্রা দেখতে আসতেন। স্বল্পমূল্যের টিকিটে সার্কাস দেখা হতো। বর্তমানে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে যাত্রাদলগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৩০০টি দল ছিল, এখন ১২-১৫টি দল টিকে থাকার চেষ্টা করছে। এক সময় বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় টানা যাত্রা হতো। বরিশাল, জামালপুর, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ জেলার ‘ভাণ্ডারিয়া, সরিষাবাড়ী, আশকানি, কালীবাড়ি মন্দির স্থানে বিশাল আকারে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হতো। ৩ থেকে ৬ মাসব্যাপী পালা চলত টানা। যাত্রা কিংবা সার্কাস ঘিরে পুতুলনাচ হতো।

মিলন কান্তি দে বলেন, লোকসংস্কৃতির অন্যতম হলো যাত্রাপালা, পুতুলনাচ ও সার্কাস। এখন যা হচ্ছে-সবই বিকৃতি ঘটছে। এক সময় প্রায় ৩ লাখ মানুষ এ লোকসংস্কৃতি ঘিরে খেয়েপরে বেঁচে থাকতেন-এখন কিছুই নেই। যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ। জেলা প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। যে কয়েকটা যাত্রাদল রয়েছে-সেগুলো শিল্পকলা একাডেমির কাছ থেকে নিবন্ধন নবায়ন করছে। তাতে লাভ নেই- কারণ প্রদর্শনীই তো হচ্ছে না।

বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ কয়েকটি বেসরকারি টিভি ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক পুতুলনাট্য পরিবেশন করছে। কয়েকটি সংগঠনও রয়েছে-যারা আধুনিক পুতুল তৈরিসহ বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে নতুন চিত্রনাট্য তৈরি করছে।

কিন্তু যথাযথ নাচ প্রদর্শন করতে পারছেন না। নতুন প্রজন্ম কিংবা শিশু-কিশোর সবাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত। দেশি-বিদেশি কার্টুনে এক প্রকার আসক্ত। তবে সরকার যাত্রা কিংবা পুতুলনাচ দলগুলোকে সহায়তার মাধ্যমে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। ৬৪ জেলায় ৬৪টি যাত্রাপালা নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, যাত্রা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প-উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

অর্ধশতাধিক সার্কাস দলের মধ্যে ২-৩টি দল টিকে আছে। এ শিল্পে থাকা শত শত শ্রমিক-কলাকৌশলী নানা সমস্যায় ভুগছেন। জীবিকা নিশ্চিত করতে অন্য পেশায় কাজ করছেন। বিশেষ করে প্রতিটি সার্কাস দলেই প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন বামন ছিলেন। সার্কাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বামন গোষ্ঠী নিরুপায় হয়ে পড়েছে। অনেকে ভিক্ষা করছেন। তাছাড়া ২-৩টি দল থাকলেও হাতি, বাঘসহ নানা ধরনের প্রাণীর অভাবে দলগুলো প্রদর্শনী করতে পারছে না।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি কাজী শয়েব রশিদ যুগান্তরকে বলেন, এখন হল নেই বললেই চলে। দেড় হাজার হলের মধ্যে ৬০টি চালু আছে। এ হলগুলোও বন্ধের পথে। সরকার আর্থিক সহযোগিতা করছে-প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে। কিন্তু ছবি তৈরি করে রিটার্ন পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে হলগুলোতে দর্শক আসছে না। হলকে ঘিরে শত শত শ্রমিক আর্থিকভাবে নানা সমস্যায় রয়েছেন। সরকার টাকা দিতে চাচ্ছে, কিন্তু হল তৈরি করতে সাহস পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।