সিলেটের নগরীতে মোটরসাইকেল চুরির হিড়িক, আতংক জনমনে

মাহবুব জয়নুল মাহবুব জয়নুল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৭:৩৯ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২১ 374 views
শেয়ার করুন

সিলেটে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে মোটরসাইকেল চুরি। বিভিন্ন যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেও চুরি ঠেকাতে না পারায় সংঘবদ্ধ চোরদের দৌরাত্ম্যে অসহায় হয়ে পড়েছেন মোটরসাইকেলের মালিকেরা। প্রায় প্রতিদিনই মহানগরীর কোথাও না কোথাও মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বেশ অন্তত ১০টি ও গত এক মাসে পুলিশ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২৫ জনের মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে চোর সিন্ডিকেট। মহানগরীতে যেনো হঠাৎ মোটরসাইকেল চুরির হিড়িক পড়েছে। এতে আতঙ্কে মোটরসাইকেলে মালিকরা অনেকেই এখন নিজ শোয়ার ঘরে মোটরসাইকেল রেখে এক সাথে ঘুমায়।

 

জানা যায়, মঙ্গলবার তারাবির নামাজের সময় উপশহরের সি ব্লকের মেইন রোডের ১৬ নাম্বার বাসা থেকে এক যুবলীগ নেতার মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। চুরি হওয়া মোটরসাইকেল হিরো গ্লামার লাল রঙ এর সিলেট-হ ১৪-৩১৩৮ নাম্বারের। একই দিন রাতেই নগরীর রায়নগর থেকে আরেকটি মোটরসাইকেল চুরির খবর পাওয়া গেছে। চুরি যাওয়া ওই মোটরসাইকেলটি রায়নগরের জমসেদ সিরাজ নামের এক ব্যবসায়ীর। এর একদিন আগে উপশহর ডি ব্লক জামে মসজিদ থেকে তারাবির নামাজের সময় গালিব নামের এক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেল চুরি হয়। এছাড়া গত ৫ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা বালুচর থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয়। গত ১ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি ভবনের সিঁড়ির নিচে বিপ্লব তালুকদার নামের এক ব্যক্তির মোটরসাইকেল চুরি হয়। তিনি ওই আদালতে চাকরি করেন।

 

উপশহরে চুরি বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিম বলেন, গত ৬ মাসে অন্তত ২০-২৫টি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। রোজা মাসে তারাবির নামাজের সময় চুরির উপদ্রব বাড়ছে বলে জানান তিনি।

ভুক্তভোগীদের দাবি, বাইকের মাথা লক করা থাকলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে চুরি হয়েছে। এ বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়েরী করলেও চুরি যাওয়া দু’একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার হলেও বেশিরভাগ হয়নি।

 

এদিকে, মোটরসাইকেল চোরদের তৎপরতা খোদ ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও। চোরদের আইনের আওতায় আনতে তারাও মাঠে নেমেছে।

 

গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, সিলেট নগরী ও শহরতলীতে গত তিন মাসে প্রায় শতাধিক মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। বিক্রি হওয়া এসব চোরাই মোটরসাইকেল অবাধে মহানগরীসহ সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা শহরে চলাচল করছে। একাধিক সংঘবদ্ধ চোর চক্র ‘মাষ্টার কি’র সাহায্যে যেকোনো মোটরসাইকেলের তালা খুলে চুরি করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ১৬/১৭ বছর বয়সী কিশোররাও রয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সিলেট পুলিশ ইতোমধ্যে ৩৭ জন মোটরসাইকেল চোরকে চিহ্নিত করেছে। এরাই জেলা শহরসহ সিলেটের বিভিন্ন উপজেলাজুড়ে মোটরসাইকেল চুরি করছে। ইতোমধ্যে এই ৩৭ জনের তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী।

 

পুলিশের তৈরি করা তালিকার প্রথমেই আছে মোটরসাইকেল চোরদের ‘দলনেতা’ দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি গাঙু এলাকার ফারুক মিয়ার ছেলে মনির আহমদ ইমন (২৬)। সে কখনো নিজ জালালপুর এলাকার মিয়াজান আলীর বাড়ি, কখনো মামা আবদুর রহমান লন্ডনীর বাড়ি আবার কখনো নগরীর উপশহর এলাকায় থাকে। তার বিরুদ্ধে এসএমপির বিভিন্ন থানায় ৬টি মামলাসহ সিলেটের অন্যান থানায়ও একাধিক মামলা রয়েছে। এরপর আছে বরইকান্দির মৃত দুদু মিয়ার ছেলে মাইদুল (৩০)। পাঁচ মামলার আসামী মাইদুল চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য। দেড় বছর আগে বাড়ি বিক্রি করে সে সিলাম চলে যায়। তার সহোদর বদরুল (৩০)ও চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য। তার বিরুদ্ধেও ৫টি মামলা রয়েছে।

 

তালিকার চার নম্বরে আছে ছাতক উপজেলার গোবিন্দনগরের মৃত নজির আহমদের ছেলে তারেক আহমদের (২৯) নাম। সে নগরীর জালালাবাদ থানা এলাকার মদিনা মার্কেটে থাকে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৬ মামলা।

 

তালিকার পাঁচ নম্বরে নাম রয়েছে দুর্র্ধষ চোর মোখলেছুর রহমানের (৩৩)। তার বিরুদ্ধে ৮ মামলা। কিশোরগঞ্জের নিখলী থানা এলাকার রসূলপুরের মৃত ছেনু মিয়া মেরাজের ছেলে। সে নগরীর মেন্দিবাগে জালালাবাদ গ্যাস অফিসের পাশে আলমগীরের কলোনীতে। এরপরেই আছে দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর পূর্বপাড়ার শহীদ আলীর ছেলে কয়েস আহমদ (৩০)। সে মোটর সাইকেল চুরি করতে গিয়ে কয়েকবার গণধোলাইও খায়, জেল খেটেছে কয়েকবার। বর্তমানেও কয়েস জেলে আছে। তার বিরুদ্ধে আছে প্রায় ১০টি মামলা আছে।

 

৭ নম্বরে নাম আছে চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য নগরীর পাঠানটুলার মোহনা ব্লকের এ ২৯/৫’র তাহের আলী পাখি মিয়ার ছেলে সেলিম আহমদের (৩০)। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৫ মামলা। এরপর আছে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানাধীন কদিমঙ্গল এলাকার স্বপন মিয়ার ছেলে মেহেদি হাসানের নাম। সে নগরীর উপশহর এলাকায় একটি কলোনীতে থাকে। চোর চক্রের সক্রিয় এই সদস্যের বিরুদ্ধে ৩ মামলা রয়েছে।

 

তালিকার ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ নম্বরে রয়েছে জৈন্তাপুরের রাইরাখেলের মৃত আলকাছ মির্জার ছেলে মো. সাব্বীর মির্জা (৩০), বিশ্বনাথের রশিদপুর এলাকার আবদুস সানিকের ছেলে রাসেল আহমদ, জালালাবাদ থানা এলাকার হাইদরপুরের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে সোহেল, শাহপরাণ থানা এলাকার খাদিমপাড়ার সফিক হোসেনের ছেলে আখতার হোসেন, মৌলভীবাজার সদরের ভৈরববাজার গিয়াসনগর এলাকার মেহের আলীর ছেলে লিটন ওরফে শাহীন (৩০)। সে নগরীর আখালিয়া নতুনবাজারের শাহেদের কলোনীতে থাকে। চোর চক্রের স্বক্রিয় এই পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ২টি করে মামলা রয়েছে।

 

তালিকার ১৪ থেকে ৩২ পর্যন্ত নম্বরে রয়েছে ছাতকের দশঘর এলাকার সিরাজের ছেলে আউয়াল হোসেন, উপশহরের তেররতন সাদারপাড়ার ৪৮/এ’র মৃত ওহাব আলীর ছেলে আবদুল মালেক (৩৫), ছাতকের দশঘর এলাকার আবুল লেইছের ছেলে আবু তাহের (১৬), একই এলাকার তাজ উদ্দিনের ছেলে হোসাইন আহমদ (১৬), জালালাবাদ আবাসিক এলাকার গোয়াবাড়ির মন্তাজ মিয়ার ছেলে কবির আহমদ (২৬), জালালাবাদ থানা এলাকার মদিনা মার্কেট নির্বাসী ৩১-এর মৃত আবদুল মতলিবের ছেলে গোলাম রব্বানী (৩৫), ছাতকের দিখালীর মৃত এখরাছ মিয়ার ছেলে এমরান হোসেন (২৭), জালালাবাদ থানা এলাকার হাওলাদারপাড়ার কালিয়ারা-৯ এর মুর্শেদ আলীর ছেলে আঙুর মিয়া (২৯), মোগলাবাজার থানা এলাকার গোটাটিকরের হারুনুর রশিদের ছেলে হাবিবুর রহমান, শাহপরাণ থানা এলাকার সৈয়দপুরের তোতা মিয়ার ছেলে রুবেল, একই এলাকার ইসলামপুরের একটি কলোনীর জামাল মিয়ার ছেলে কামরুল ওরফে কব্বুল, এয়ারপোর্ট থানা এলাকার বাইশটিলার মো. হানিফের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (১৬), মৌলভীবাজারের রাজনগরের গালিমপুর এলাকার মৃত সিদ্দিক আলীর ছেলে করিম আহমদ, দক্ষিণ সুরমার দক্ষিণ বলদি রাজবাড়ির রাজু আহমদের ছেলে সানজিদ আহমদ হাসান, দক্ষিণ সুরমার কৃষ্ণপুরের লোকমানের ছেলে লিটন, শাহপরাণ থানা এলাকার শান্তিবাগের মুজিবুর রহমানের ছেলে মো. এরশাদ (২৬), একই এলাকার সবুজবাগের আবদুল জলিলের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২১), জকিগঞ্জের পীরনগর কাজী বাড়ির মৃত কাজী আবদুল খালিকের ছেলে কবির আহমদ (৩২), নগরীর সওদাগরটুলা-৭২ এর আনোয়ার হোসেন আনা মিয়ার ছেলে ইকবাল হোসেনের (৩৪) নাম। আবদুল মালেক ছাড়া বাকি ১৭ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ১ টি করে মামলা। আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে আছে ২ মামলা। পুলিশের খাতায় এরা প্রত্যেকেই চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য।

 

তালিকার ৩৩ থেকে ৩৬ নম্বরে জালালাবাদ থানা এলাকার পাঠানটুলার মাজেদ, দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার দিলু (২৪), হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের নয়নী এলাকার লেবু মিয়ার ছেলে নয়ন (২৮), মোগলাবাজার থানা এলাকার শিববাড়ির একটি কলোনীর হাসন আলীর ছেলে আরশ আলী’র (২৭) নাম রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও পুলিশের তালিকায় তারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে চোরচক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে। তালিকার সর্বশেষ নাম ফরিদুল আলম (৩৭)। কুটি মেম্বার হিসেবেই যার পরিচিতি। তার বাড়ি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দুর্গাপুরে। তার বাবার নাম আজিম উল্লা। একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চুরি হওয়া বেশিরভাগ মোটরসাইকেল কুটি মেম্বারের কাছে চলে যায়। চোরদের সাথে রয়েছে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ। চুরি করা মোটরসাইকেল তার মাধ্যমেই বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে দলনেতা ইমন তার ‘ছায়াসঙ্গি’।

 

এ প্রসঙ্গে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া ও কমিউনিটি সার্ভিস) আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, চোরদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মোটরসাইকেল চুরি ঠেকাতে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন চোরকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।