ছোট আপা, শেখ রেহানার আরেক নাম

প্রকাশিত: ৩:০০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০ 703 views
শেয়ার করুন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সবার কাছে ছোট আপা নামেই বেশি পরিচিত। খুব প্রিয় তিনি সকলের। হাস্যোজ্জ্বল স্নিগ্ধ একটা ব্যক্তিত্বের অধিকারী তিনি। কথা বলেন একেবারে পাশের বাড়ির বোনটির মতো।

২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি বিকেলে গণভবনে লেখক-শিল্পী-সাংবাদিকদের চায়ের নিমন্ত্রণ করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোদ ঝলমল সেই অনিন্দ্যসুন্দর বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বিশাল ব্যাকইয়ার্ডটি দেশের বিখ্যাত মানুষদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিলো।

কতো কতো প্রিয় মানুষের সঙ্গে যে দেখা হলো! এক পর্যায়ে আমার কুশল জানতে এগিয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, সবাই যাঁকে ছোট আপা বলে ডাকে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন কানাডায় আমার প্রবাস জীবনের কথা। তিনি জানেন প্রবাসী হবার বেদনাটা কেমন। তাঁরা দুই বোন ১৯৭৫-এর পর এইদেশ সেইদেশ কতো দেশেই না ছুটে বেরিয়েছেন একটা নিরাপদ জীবনের সন্ধানে!

আমার সঙ্গে যে ক’বারই দেখা হয়েছে ছোট আপার, আমি তাঁর স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব আর পরিচ্ছন্ন রুচির পরিচয় পেয়েছি। আমাকে একজন লেখক হিশেবে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। আপনজনের মতো খোঁজ নিয়েছেন আমার পরিবারের। খোঁজ নিয়েছেন লেখালেখির। তাঁর কথায় আচরণে খুব রুচিস্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন একজন মানুষের প্রকাশ দেখেছি সব সময়। তাঁর পোশাক, শাড়ি, অলংকার সব কিছুতেই কেমন অপরূপ বাঙালি মায়ের বোনের চিরকালের মমতাময় রূপটিই ফুটে ওঠে সব সময়।

  • তিনি কথাও বলেন খুব গুছিয়ে। তাঁর একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম ফেসবুক আর ইউটিউবের কল্যাণে। এতো গুছিয়ে একটাও বাহুল্য শব্দ উচ্চারণ না করে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে খুব আটপৌরে ভাষা ও ভঙ্গিতে এমন কিছু কথা তিনি বলেছিলেন,যা একই সঙ্গে বুক ভাঙা এবং প্রেরণাদায়ী। জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর বানানো পিপলু খানের অসাধারণ ডকুফিকশন ‘হাসিনা এ ডটার্স টেল-এ’ ব্যবহৃত শেখ রেহানার কথাগুলোও হৃদয় মোচড় দেয়া। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা আমার সঙ্গে একমত হবেন আমি নিশ্চিত।

  • বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র রাসেলকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলাম আমি। বইটির নাম ‘শেখ রাসেলকে লেখা চিঠি’। প্রকাশক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। অক্টোবর ২০১৫ সালে প্রকাশিত বইটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম–”পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলির নিশানা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ রাসেলের প্রিয় দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখা রেহানা।’

সেই বইতে রাসেল নামের অতি আদরের ছোট্ট ভাইটিকে নিয়ে শেখ রেহানার লেখা একটি স্মৃতিগদ্য থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছিলাম। ছোট ছোট বাক্যে লেখা মায়াময় সেই স্মৃতিগদ্যটির কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরছি। শেখ রেহানা লিখেছেন–”আমাদের দু’বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে রাসেল ছিলো সবার ছোট। তাই আমাদের সবার আদরের ভালোবাসার চোখের মণি ছিলো ও। মা বলতেন, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকো, তাহলে তোমাকে ছোট্ট একটা বাবু এনে দেবো। মা-র কথামতো লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতামকখন মা আমাকে একটা বাবু এনে দেবে। রাসেলের জন্ম হয় অনেক রাতে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার মেজো ফুপু ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, জলদি ওঠো, তোমার ভাই হয়েছে। জন্মের পরে ওকে আমার মনে হয়েছিলো একটা পুতুল। কী সুন্দর হাসে, আবার কাঁদেও!……রাসেল বরিশাল, ফরিদপুর ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ও উর্দু মিশিয়ে একটা নিজস্ব ভাষায় কথা বলতো। ও খুব দুষ্টু ছিলো। পেছন থেকে এসে ভয় দেখাতো। তবে ওর হাসিটি খুব মিষ্টি ছিলো। সামনের দাঁত পোকায় খাওয়া তাই ফোঁকলা মুখে কথা বলতো। ……রাসেলের জন্মের পর দীর্ঘ সময় আব্বাএ জেলে কেটেছে। আব্বাকে দীর্ঘ সময় দেখতে না পেয়ে রাসেলের মন খারাপ করতো। কাঁদতো আব্বার কাছে যাবার জন্য। ওর জন্য আমাদেরও খারাপ লাগতো। ওকে তাই খেলার মধ্যে ভুলিয়ে রাখতাম। মা ওকে প্রথমে একটা তিন চাকার সাইকেল কিনে দেন। সারাদিন সাইকেল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। ওর খুব প্রিয় ছিলো সাইকেলটা। ……রাসেলের স্কুল যাওয়া শুরু চার বছর বয়েসে। ও ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়। প্রথম প্রথম ওর সঙ্গে আমাদের কাউকে যেতে হতো। হাসু আপা, কামাল ভাই, জামাল ভাই অথবা আমি ওকে স্কুলে নিয়ে যেতাম। দাঁড়িয়ে থাকতাম বাইরে। ক্লাশে নাম ডাকার সময় রাসেল হাত তুলে ‘এই যে আমি’ বলতো। চোখ রাখতো বাইরে আমরা আছি কিনা দেখার জন্য। কিছুদিন পর আমরা আর যেতাম না। স্কুলে ওর অনেক ভালো বন্ধু জুটে যায়। প্রথম প্রথম স্কুলে যেতে চাইতো না সে। বলতো–আজ তো সোমবার, স্কুলে যাবো না। পরে স্কুলের প্রতি ওর আকর্ষণ বেড়ে গেলো। স্কুলে যাবার জন্য নিজেই তৈরি হতো। ……আব্বা পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসার পর রাসেল সব সময় তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতো। ……রাসেলের প্রিয় খাবার ছিলো চকোলেট, সমুচা, কোক। কখনো যদি পোলাও ও ডিমপোচ খেতো তাতে আবার চিনি দিতে হতো। আমাকে ডাকতো ‘দেনা আপু’ বলে। আমার হাতে রান্না দুধ শেমাই খেতে বায়না ধরতো। ……১৯৭৫ সালে আমাদের সঙ্গে রাসেলেরও জার্মানি যাবার কথা ছিলো। কিন্তু মা ওকে যেতে দেননি। গেলে আজ আমরা তাকে হারাতাম না। জার্মানিতে বেড়াবার ফাঁকে ফাঁকে রাসেলের জন্য খেলনা ও জুতো কিনেছিলাম, সেগুলো এখনও আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে আছে। আমি রাসেলকে একটা চিঠি লিখে পোস্ট করেছিলাম, রাসেলের হাতে তা পৌঁছেনি। পঁয়ত্রিশ বছর পরে সেই চিঠি আমার কাছেই ফিরে আসে! রাসেলকে নিয়ে কখনো কিছু লিখতে হবে কল্পনা করিনি। আজো রাসেল আমার চোখে সেই দশ বছরের ভাইটি রয়ে গেছে। ঐ বয়সের কাউকে দেখলে আমার চোখে রাসেল ভেসে ওঠে। আমার ছেলে ববি জন্ম নেবার পর ওকেও আমি অনেকদিন রাসেল নামে ডেকেছি!”

আহারে! শেষ বাক্যটা পাঠককে অশ্রুসজল করে তোলে। আমাকেও। ভাইয়ের প্রতি বোনের এই মমতা চিরকালের। এই হাহাকার চিরকালের। এই স্নেহের এই মায়ার এই ভালোবাসার সম্পর্ক আবহমান কালের।

আজ ১৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার জন্মদিন।
বারো হাজার তিনশো কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডা থেকে আপনার ৬৫তম জন্মদিনে অনেক অনেক শুভ কামনা প্রিয় ছোট আপা।

অটোয়া ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০