আমাদের সমাজ দেশ ও তার স্বঅবস্থান। সমাজের মধ্যে যেমন, সদস্যদের মাঝে পরস্পর সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, মমত্ব ; তেমনি তৈরি হতে পারে ঘৃণা, লোভ, জিঘাংসা। তাই সমাজের মধ্যে শৃংখলা ধরে রাখার স্বার্থে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অলিখিতভাবে তৈরি হয় কিছু নিয়ম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার লঙ্ঘন চরম অসম্মানজনক, এবং সমাজের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য।
তবে নিঃসন্দেহে সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার জন্য সৌহার্দ্য, সহযোগিতা একান্ত দরকার। পৃথিবীর যেকোনো জনপদে উন্নয়ন কতগুলো আপাত পরস্পরবিরোধী ঘটনাকে একই প্ল্যাটফর্মে এনে স্থান দেয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে সম্প্রতি সামাজিক রূপ বদলের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আমরা তাকে ‘উন্নয়ন’ হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারি। তবে যে উন্নয়ন মূল রূপকে বদলে দেয় তা কতোখানি সুখকর ও সুনিশ্চিত ভবিষ্যত্ নির্মাণ করে তা প্রশ্নের দাবি রাখে।
এই উন্নয়ন গ্রামকে শহরের দিকে এবং হয়তো একসময় শহরের পর্যায়ে উন্নীত করবে। শহরই সভ্যতার দৃষ্টিতে সভ্য মানুষের আবাসস্থল, যদিও এর আদর্শ সমাজ গঠন, সমাজের প্রধান উপাদান ব্যক্তি। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তিগঠনই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোন আদর্শ বা চেতনা যত সুন্দরই হোক, যদি সেই আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিগঠন না করা হয় তাহলে আদর্শ সমাজ গঠনের স্বপ্ন একসময় ধুলোমলিন হয়ে যাবে।
সেই সাথে তার বাস্তবায়নও হয়ে পড়বে অসম্ভব এবং সুদূরপরাহত বিষয়। আদর্শ সমাজ গঠন করতে হলে এ ব্যাপারে যার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কোন ব্যক্তি জ্ঞানের সাগর বা পন্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি নৈতিক চরিত্রের অধিকারী না হন, তাহলে তিনি সমাজে একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবেন না। তাই নৈতিকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চারিত্রিক নৈতিকতার দুটি দিক রয়েছে। ইতিবাচক দিক বা অর্জনীয় গুণসমূহ।
বিনয় ও নম্রতা, স্নেহ ও মায়া, দয়া ও সহমর্মিতা, সবর ও শোকর, ক্ষমা ও উদারতা, অল্পেতুষ্টি ও দানশীলতা, ইহসান ও লজ্জাশীলতা, সততা ও সত্যবাদিতা, আমানতরক্ষা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং ত্যাগ ও ইত্যাদি।নেতিবাচক দিক বা বর্জনীয় গুণসমূহ। যথা- অহংকার ও আত্মগর্ব, ক্রোধ ও লৌকিকতা, লোভ ও লালসা, হিংসা ও বিদ্বেষ, গীবত ও পরনিন্দা, চোগলখুরি ও পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যা ও অপবাদ, খেয়ানত ও মন্দ ধারণা, অশ্লীলতা ও কামাসক্তি, কৃপণতা ও জুলুম এবং কোন মানুষকে অপমান করা ইত্যাদি। চারিত্রিক নৈতিকতার এই অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণগুলোর মাঝে সমন্বয় ঘটানো ছাড়া একজন মানুষ নৈতিক চরিত্রের শীর্ষচূড়ায় পৌঁছতে পারবে না। গঠিত হবে না আদর্শ ব্যক্তিসত্ত্বাও।
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ব্যক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কয়েকজন ব্যক্তি মিলে গঠিত হয় পরিবার। কয়েকটি পরিবার মিলে গঠিত হয় সমাজ। আর বহু সমাজের সামষ্টিক রূপ হলো-রাষ্ট্র। তাই আদর্শ সমাজ গঠনে ব্যক্তির বিকাশ ও গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম।সার্বিক সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। অপরদিকে, গ্রামীণ সংস্কৃতিই আবহমান বাংলার মূল চরিত্রের বাহক। যদিও সকল অঞ্চলে এর হার সমান ও সমধর্মী নয়।
এই তারতম্যের অন্যতম কারণ গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বসবাসকারী জনপদের মানসিকতা। শহরের নিকটে অবস্থিত গ্রামসমূহ সহজেই শহরের সান্নিধ্য ও বৈশিষ্ট্য লাভ করে যা অনেক ক্ষেত্রে পারে না দূরবর্তী গ্রামগুলো। উন্নয়ন ও পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হওয়ার পথে সময়ে সময়ে অনেক অসন্তোষ জন্ম নেয়। গ্রামীণ ট্র্যাডিশনাল সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনও এর থেকে পৃথক কিছু না। পরিবার প্রথার রদবদল ঘটছে, পরম্পরাগত একান্নবর্তী ও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠছে। তরুণদের একাংশ বহিঃসংস্কৃতির নেতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে সামাজিক সুস্থতার ধারা বিনষ্ট করছে। নেশা, সহিংসতা, নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর সামাজিক অপরাধ দেখা দিচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের পুরনো চরিত্র বদলে যাওয়ার কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সংঘশক্তি কমে যাচ্ছে, আলগা হয়ে পড়ছে সামাজিক বন্ধন। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক উত্সবসহ লোকসংস্কৃতির বিবিধ ধারা বিলোপের ক্ষেত্রে এটি একটি পরোক্ষ নিয়ামক। প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজের সঠিক নিয়ম মেনেই যদি সমাজ পরিচালনার সহায়ক হতে পারি, তাহলেই পরিবার, সমাজ, ও দেশ উপকৃত হবে।


