আমার জগৎটাকে রঙে-রেখায়-গানে-লেখায়–কী রকম ভরিয়ে রেখেছেন একজন সত্যজিৎ!

প্রকাশিত: ৪:১২ অপরাহ্ণ, মে ২, ২০২০ 591 views
শেয়ার করুন

সত্যজিৎ রায় আমার খুব প্রিয়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমি আর শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম একবার (১৯৮৪ সালে) চলে গিয়েছিলাম যশোর বেনাপোল বর্ডার দিয়ে বনগাঁ পেরিয়ে কলকাতা বিশপ লেফ্রয় রোডের কাঠের সিঁড়িঅলা বিখ্যাত সেই বাড়িতে। যেথায় বসত করেন সত্যজিৎ। আমার প্রিয় সত্যজিৎ। কতো প্রিয়? ভীষণ প্রিয়। কী প্রিয় নয় সত্যজিতের! তাঁর ফিকশন প্রিয়। তাঁর বুক ডিজাইন, লেটারিং, ইলাস্ট্রেশন, প্রচ্ছদ, পোস্টার ডিজাইন প্রিয়। তাঁর ডিরেকশন, মুভি, মিউজিক সব প্রিয়। তাঁর ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটা আমার মুখস্ত আদ্যোপান্ত। ইন্টারল্যুড মিউজিকসহ। সব মিলিয়ে সত্যাজিৎ আমার কতো প্রিয় সেইটা বোঝাতে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফিরে যেতে হবে।

স্কুলে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় ফিলাপ করতে হয় ফরম। ওখানে জন্মতারিখের একটা ঘর থাকে। দেশের অধিকাংশ শিক্ষক ছাত্রদের উপকারার্থে চাকরির বয়েসের হিশাব ঠিক রাখতে বানোয়াট একটা তারিখ বসিয়ে দেন। যে কারণে ‘‘১লা জানুয়ারি’’ এতো অধিকসংখ্যক মানুষের জন্ম!! নবাবপুর স্কুলে আমার জন্মতারিখটাও ১লা হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়! আমি একলা ওই ১লা-কে ঠেকিয়েছিলাম তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে! স্যারের সঙ্গে লড়াই করে ১লা জানুয়ারি থেকে এক লাফে চলে গিয়েছিলাম মে মাসে। জন্মতারিখের ঘরে আমি জবরদস্তি বসিয়েছিলাম দোসরা মে। কারণ ওইদিন আমার প্রিয় সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন!

আজ দোসরা মে। আমার কাল্পনিক আর সত্যজিতের সত্য জন্মদিন!
শুভ জন্মদিন গুরু!

ভেবে অবাক হই সত্যজিৎ রায় নামের বিস্ময়কর এই মানুষটা একাই আমার জগৎটাকে রঙে-রেখায়-গানে-লেখায়–কী রকম ভরিয়ে রেখেছেন!

  • কথা না বাড়াই। তারচে হীরক রাজার দেশে-র দুর্দান্ত সেই গান—আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে/শাখে শাখে পাখি ডাকে কতো শোভা চারিপাশে…শুনতে শুনতে গুরুর সঙ্গে আমার দেখা হবার গল্পটা আরেকবার বলি। সত্যজিৎসান্নিধ্যের গল্প বারবার বলতে ইচ্ছে করে।

প্রবাসে প্রতিবছর তাঁর জন্মদিন আমি পালন করি একান্ত নিজস্ব কিছু তরিকায়। যেমন ওইদিন আমার বাড়িতে সারাদিন সত্যজিতের গান বাজে। কিংবা ওইদিন আমি তাঁর পরিচালিত প্রিয় কোনো চলচ্চিত্র দেখি। কিংবা ওইদিন সারাদিন আমি কেবল সত্যজিৎ রায়কে পাঠ করি। একবার করেছিলাম ‘সত্যজিৎ চলচ্চিত্র সপ্তাহ’। ২মে শুরু করে সাত দিনে সাতটা ছবি দেখেছিলাম। এবার করোনার লকডাউনকালে তাঁর জন্মদিনটাকে উদযাপন করছি শুধুই গান শুনে।

”শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম সত্যজিৎভক্ত। যেমন তেমন ভক্ত নয়। ভয়াবহ ভক্ত। সত্যজিৎভক্ত আমিও। তবে আলী ইমামের মতো না। স্কুল জীবনে পথের পাঁচালি দেখে আলী ইমাম কাঁদেন। অপুর জন্যে কাঁদেন। দূর্গার জন্যে কাঁদেন। পথের পাঁচালি দেখে আমারো মন খারাপ হয়। অপুর জন্যে। দূর্গার জন্যে। কিন্তু আমি কাঁদি না।
আমরা দুজনেই সত্যজিতের বইয়ের পোকা। সত্যজিতের সিনেমার পোকা। সত্যজিতের যাবতীয় কর্মকান্ড আমাদের নজরবন্দি। সত্যজিতের পথের পাঁচালি আলী ইমামকে এতোটাই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে যে, তাঁর একটি ছোটভাই জন্মালে সে তার নাম রাখে অপু। পারলে সত্যজিতের নামে নিজের নাম রাখে আলী ইমাম, পরিস্থিতি অনেকটা সেরকমই। কলকাতায় একবার সত্যজিতের বাড়িতে গিয়ে সত্যজিতের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর স্বপ্ন তাঁর দীর্ঘদিনের। সত্যজিৎ দর্শন না হলে আলী ইমামের –জীবন প্রায় বিফলে যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা—হয়তো কিছুই নাহি পাবো তবুও তোমায় আমি দূর থেকে ভালোবেসে যাবো টাইপের। দেখা হলে ভালো। দেখা না হলে জীবন আমার বৃথা যাবে না। কিন্তু আলী ইমামের যাবে।

এক সন্ধ্যায় আলী ইমাম আমাকে পাকড়াও করলেন—চলো, আমরা দুজন মিলে সত্যজিৎকে নিয়ে একটা বই লিখি। যৌথ বই। এক মলাটে দুজন লেখক।
আইডিয়াটা আমার পছন্দ হলো। আমি বইটার নাম দিলাম—বিষয় সত্যজিৎ। আলী ইমাম ভাই নামটা লুফে নিলেন—বাহ্‌ বিষয় চলচ্চিত্রের লেখকের ওপর বই বিষয় সত্যজিৎ। আলী ইমাম দ্রুত কাগজে কলমে লিস্টি করে ফেললেন আমরা কে সত্যজিতের কোন বিষয়ের ওপর লিখবো। লিস্টির কপিও করে ফেললেন দ্রুত। একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। লিখতে হবে তাড়াতাড়ি। আগামী বইমেলায় প্রকাশিত হবে আমাদের যৌথ বই—বিষয় সত্যজিৎ। উত্তেজনায় আলী ইমাম দেখলাম কাঁপছেন রীতিমতো।

  • আরেক সন্ধ্যায় আমাকে আবারো পাকড়াও করলেন আলী ইমাম ভাই—চলো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। এরকম একটা দারূণ কাজ হবে তাঁর ওপর আর সেটা তাঁকে জানাবো না!আলী ইমাম ভাই তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে ব্যাকুল–এমন চমৎকার একটা সুযোগ এসেছে তা কি হাতছাড়া করা উচিৎ? মোটেও না। তুমি চলো আমার সঙ্গে।

সত্যজিৎ সান্নিধ্যের হাতছানিতে আমিও কাবু। ১৯৮৪-র সেপ্টেম্বর। ওয়ান ফাইন মর্নিং আমি আর আলী ইমাম ভাই চললাম গুরু দর্শনে। সত্যজিতের ফিকশন, বুক ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন, লেটারিং, মুভি,ডিরেকশন, মিউজিক সবকিছু নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে করতে বেনাপোল বর্ডার ক্রস করে আমরা পৌঁছে গেলাম কলকাতা।

খুব দ্রুত মুগ্ধ হবার বিপুল শক্তি আলী ইমামের। কলকাতার যা-ই দেখেন মুগ্ধ হয়ে যান। কারণ—এই শহরে সত্যজিৎ রায় থাকেন!
আমরা উঠেছি বালিগঞ্জের একটা বাড়িতে। রনিদের বাড়িতে। রনি হচ্ছে আলী ইমামের কঠিন ভক্ত আলোকচিত্রি মিঠুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিঠুর তত্বাবধানেই আমাদের থাকার জায়গা নির্ধারিত হয়েছে। মিঠু ওখানে আমাদের আগেই পৌঁছানো অবস্থায় ছিলো।

রনির সঙ্গে খুব দ্রুতই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। খুবই চটপটে ছেলে। কিন্তু সত্যজিতকে পছন্দ করে না। বলে—ওই ঢ্যাঙাটা লোকজনের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে।
সত্যজিৎকে ঢ্যাঙা বলায় আহত আলী ইমাম করুণ ভাবে জানতে চাইলেন—কি রকম?
–আর বলবেন না, লোকজনকে পাত্তাই দিতে চায় না। কদিন আগে এক মন্ত্রি গিয়েছিল ঢ্যাঙাটার বাড়িতে। দরোজা খুলে এপয়েনমেন্ট না নিয়ে এসেছেন বলে ধড়াম করে মন্ত্রির মুখের ওপর দরোজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো।
আমি বলি—সর্বনাশ! আলী ইমাম ভাই আমার সত্যজিৎ সান্নিধ্যের দরকার নাই।
আলী ইমাম ভাই বলেন, এতোদূর এসেছি একটা ট্রাই করতে দোষ কি!
রনি-ই সত্যজিতের ফোন নাম্বারটা যোগাড় করে দিলো। সন্ধ্যায় উত্তেজনায় কম্পমান আলী ইমাম ফোন করলেন—জ্বি জ্বি আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমার নাম আলী ইমাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রডিউসার।
অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো তিনি বাড়িতে নেই।

পরদিন সকালে আবারো প্রচেষ্টা চালালেন আলী ইমাম ভাই। এইবার ফোন রিসিভ করেছেন সত্যজিৎ স্বয়ং।
স্মার্ট কথক আলী ইমাম নিজের লেখক পরিচিতির চাইতে টিভির প্রডিউসার পরিচয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দিলেন। ওপাশে সত্যজিত রায় জানতে চাইলেন দেখা করতে চাওয়ার হেতু। গড়গড় করে বলে চললেন আলী ইমাম তাঁর সুললিত শব্দ ও বাক্যচয়ন ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে– বিটিভিতে আমার প্রযোজনায় ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ নামে একটি অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এ আমি গিয়েছিলাম মসুয়া গ্রামে। কিশোরগঞ্জের মসুয়া। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ভিটে। আপনার পূর্বপুরুষের এই ভিটের ওপর আমি একটা ডকুমেন্টারি করছি। এছাড়া আমি আর লুৎফর রহমান রিটন মিলে আপনার ওপর একটা বই লিখছি। বইটির নাম ‘বিষয় সত্যজিৎ’। বাংলাদেশ শিশু চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি আমি। রিটন সাধারণ সম্পাদক।

আলী ইমামের মসুয়া ডোজে কাজ হলো। অপর প্রান্ত থেকে থেকে বলা হলো—আমি খুবই ব্যস্ত। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দেয়া যাবে না। আলী ইমাম ভাই বললেন—পাঁচ মিনিটেই হবে।

টেলিফোন শেষে আলী ইমাম ভাই ঘাম দিয়ে জ্বর সারা মানুষের মতো জবুথবু হয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। অনেক বেশি মানসিক চাপে ছিলেন তিনি এতোক্ষণ।

পরদিন ঘড়ির কাটায় কাটায় ঠিক সকাল দশটায় আমি মিঠু আর আলী ইমাম ভাই হাজির হলাম কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই বিখ্যাত বাড়িতে। বেশ বড়সড় প্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি ভেঙে পায়ে পায়ে পৌঁছুলাম দোতলায়। দরোজায় কড়া (কলিং বেল)টিপলাম। বিশাল দরোজা সামান্য খুলে গেলো। না, আমাদের তিনজনার নাক বরাবর কেউ নেই। যিনি দরোজা খুলেছেন তিনি এতো লম্বা যে আমাদের তিনজনকেই ঘাড় পেছন দিকে বাঁকিয়ে প্রায় আকাশ দেখার মতো করে উঁচুতে তাকাতে হলো। আরে অইতো! গুরু স্বয়ং দরোজা খুলেছেন! আমরা কিছু বলার আগেই অসাধারণ গমগমে ভরাট কন্ঠে বললেন তিনি—বাংলাদেশ থেকে?

আমরা যৌথ কন্ঠে—‘জ্বি’ বলতেই ‘পাঁচ মিনিট কিন্তু’–বলতে বলতে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন বসার ঘরে। সেই বিখ্যাত কক্ষে। এই কক্ষের ছবি কতো দেখেছি! এইখানে বসে সত্যজিৎ রায় কতো ইন্টারভিউ দিয়েছেন! এইতো যে চেয়ারটায় তিনি বসেছেন সেই চেয়ারে বসা ছবিও তো কম দেখিনি। ওই যে পেছনে বড় জানালা। জানালার বাইরে গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি।। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে প্রশান্তিতে ভরে গেলো মন। এখানে ওখানে এতো এতো বই। শাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে অপূর্ব লাগছিলো তাঁকে। আমাদের শৈশব কৈশোরের হিরো সত্যজিৎ রায়। আমাদের জীবনকে রঙে রেখায় ছন্দে ছবিতে ভরিয়ে দিয়েছেন এই মানুষটি।

দীর্ঘদেহী সত্যজিৎ রায়কে ছুঁয়ে দেয়া যায় দূরত্বে বসে আছি আমরা তিনজন। মিঠু আর আলী ইমাম ভাই বসেছেন সত্যজিতের সামনের ডানদিকের সোফায়। আমি বাম দিকে। সত্যজিৎ আমাদের মধ্যিখানে। সামনের টেবিলের ওপর লম্বা পা দুটি ঠেকিয়ে দিয়ে বসেছেন তিনি। দুই হাঁটুর ওপর একটা ইজেল টাইপের কাঠের স্ট্যান্ডে ওপর নিচে দুটো বোর্ড। নিচের বোর্ডটার ওপরে শাদা ফুলস্কেপ কাগজের তিন চারটা পাতা আড়াআড়ি করে রেখে খসখস করে লিখছেন কি যেনো। লিখছেন আর আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

একজন মানুষ একই সঙ্গে দুটি বিষয়ে মনোযোগ দেন কি করে? আমার সন্দেহ হলো তিনি আমাদের কথা শুনছেন না। ওদিকে আলী ইমাম ভাই চমৎকার বিশুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন তাঁর মুগ্ধতার কথা। মসুয়া গ্রামের কথা। আমাদের দুজনার সাম্প্রতিক পরিকল্পনার কথা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়সহ আরো কিছু বিশিষ্ট বাঙালির সঙ্গে। ঢাকার সেই সংবর্ধনায় দেয়া বক্তৃতায় সত্যজিৎ পুরনো ঢাকার বাঁদরের উৎপাতের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আলী ইমাম ভাই বলতে ভুললেন না যে আমরা পুরান ঢাকার বাসিন্দা এবং বাঁদরদের বহু বিচিত্র উৎপাতের বিপুল অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের বিশেষ করে আমার। এক পর্যায়ে আমার সন্দেহ প্রবল হলো যে তিনি আমাদের কথা একদমই শুনছেন না। নিবিষ্ট মনে কিছু একটা লিখছেন বা আঁকছেন। আলী ইমাম ভাইয়ের চলমান কথার মাঝখানে ইচ্ছে করেই আমি ইনসার্ট বসালাম—কী লিখছেন আপনি?

ধরেই নিয়েছিলাম যে সত্যজিৎ রায় আমাদের কথা কানেই নিচ্ছেন না কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সত্যজিৎ রায় উত্তর দিলেন গমগমে কন্ঠে—গুপি বাঘা ফিরে এলো ছবির গানের নোটেশন লিখছি।
–একটু দেখি?
–ইচ্ছে হলে দেখতে পারো।

আমি আর আলী ইমাম তড়াক করে উঠে পড়লাম। দুদিক থেকে দুজনে তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সত্যজিতের হাতের লেখা আমাদের কাছে এতোটাই প্রিয় আর পরিচিত যে আমরা সেই চেনা হস্তাক্ষরে লেখা গান এবং গানের নোটেশন তৈরি হবার ঘটনা চাক্ষুষ করে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ফিরে এসে বসলাম যার যার আসনে। আমাদের বিষ্মিত করে সত্যজিত জানতে চাইলেন আলী ইমামের কাছে—পুরনো ঢাকার বাঁদর প্রসঙ্গে বলছিলে….

আমরা দুজনেই বুঝে গেলাম ভয়াবহ রকমের কঠিন জিনিস সত্যজিৎ রায়। তার মানে গানের নোটেশন রচনার সময় প্রতিটা মুহূর্ত তিনি আমাদেরও খেয়াল করেছেন!

আলী ইমাম ভাই এতো চমৎকার করে ডিটেইল বর্ণনা করছিলেন মসুয়া গ্রামের যে সেই গ্রামটিকে আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। উপেন্দ্রকিশোরের ভিটের উঠোনে গাছের পাতার ফাঁক গলে রোদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। গ্রামের সবচে প্রবীন বুড়োটা সেই ঐতিহাসিক বাড়িটার অতীত গৌরবকাহিনি বর্ণনা করছে পরম নিষ্ঠা আর গভীর আন্তরিকতায়। কেউ একজন ক্ষমতাবান লোভী ধনাঢ্য ব্যক্তি জবরদখল করে নিতে চাইছে বাড়িটাকে। আলী ইমাম ভাইয়ের দুর্ধর্ষ উপস্থাপনায় সত্যজিতের মতো তুখোড় মানুষও কিঞ্চিৎ টাল খেয়েছেন বোঝা গেলো। নোটেশন রচনা ক্ষ্যান্ত দিয়ে তিনি আমাদের দিকে একশ ভাগ মনোযোগী হলেন।

আমাকে দেখিয়ে আলী ইমাম ভাই বললেন, আপনার হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটির আদ্যোপান্ত–সমস্ত সংলাপ রিটনের মুখস্ত। সব কটা গানই ও গাইতে পারে ইন্টারল্যুড মিউজিকসহ। আমার দিকে কৌতূহলী সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন সত্যজিৎ রায়। আমি বললাম, তিন রায় আমার প্রিয় ছড়াকার। সুকুমার রায় সত্যজিৎ রায় আর অন্নদাশংকর রায়। এরপর নাগাড়ে অনেক কথা বললাম আলী ইমাম ভাই আর আমি। আমাদের দুজনার কথাবার্তায় সত্যজিতের বুঝতে বাকী থাকলো না যে আমরা দুজন মোটামুটি সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ। (আলী ইমাম ভাই অবশ্য এই ব্যাপারে পিএইচডি রীতিমতো!)

আমাদের জানা ছিলো–কিছুদিন আগেই কঠিন অসুখ থেকে সেরে উঠেছেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে ছবি তোলা বারণ। কারণ, ক্যামেরার ফ্লাশ থেকে ছিটকে বেরুনো আলো তাঁর চেহারায় বিশেষ করে মুখের ত্বকের ক্ষতিসাধন করতে পারে। সুতরাং ছবি তোলা বারণ। তারপরেও মিঠু আমাদের সঙ্গি হয়েছে কাঁধে দু’দুটো ক্যামেরা ঝুলিয়ে। ছবি তুলতে না পারুক, সত্যজিৎ সান্নিধ্যের স্মৃতিটুকুও তো এক জীবনের পরম পাওয়া। এই মহার্ঘ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকতে চায়নি সে। নাই বা হলো ছবি তোলা।

কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সত্যজিৎ রায়ই বললেন, ছবি তুলতে চাইলে খুব দ্রুত তুলে নাও।
আরে!বলে কি!! এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! মিঠু ঝটপট ক্যামেরার শাটার টিপতে থাকলো। এক পর্যায়ে আমি আর আলী ইমাম ভাই গিয়ে দাঁড়ালাম সত্যজিৎ রায়ের পেছনে। আমরা দুজন দারূণ খুশি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছবি তোলার আনন্দে। মিঠুও দারূণ খুশি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলতে পারার আনন্দে। দু’ধরণের ছবি তুলেছে মিঠু, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট এবং ট্রান্সপারেন্সি।

আমাদের তিনজনকে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন সত্যজিৎ রায়। কারণ দরোজাটা সম্ভবত তাঁকেই বন্ধ করতে হবে।

সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে প্রায় একই সঙ্গে ঘড়িতে সময় দেখলাম আমি আর আলী ইমাম ভাই। তারপর দুজনেই হেসে উঠলাম, বিজয়ীর হাসি—বাইশ মিনিট! পাঁচ মিনিটের জায়গায় বাইশ মিনিট সময় পেয়েছি আমরা!

গুপী আর বাঘার মতোই ফূর্তিতে ডগোমগো আমরা দুজন–আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…।”

শুভ জন্মদিন গুরু।

অটোয়া ০২ মে ২০২০