বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা এবং আমাদের মানব সম্পদ বিনির্মাণ

প্রকাশিত: ১২:৩৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০২০ 733 views
শেয়ার করুন

শিক্ষা অর্জনে মানব আচরণের কাঙ্খিত ইতিবাচক পরিবর্তন হয়। শিক্ষার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর শেষে একজন স্বপ্নবিলাশী শিক্ষার্থীরা পা রাখে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত আঙিনায় জ্ঞানের খুঁজে, মুক্তির মিছিলে জীবনের পরিপূর্ণতার স্বাদ আস্বাদনে। শিক্ষার মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীকে অজানা থেকে জানার রাজ্যে নিয়ে আসা, জীবনে মুক্তির স্বাদ পেতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আলোকবর্তিকার ন্যায়। গ্রিক পন্ডিত এরিস্টটল বলেন “শিক্ষার শেকড় তেতো হলেও এর ফল মিষ্টি।”

শিক্ষা হচ্ছে আলো, যে আলোয় আলোকিত হয় আমাদের মনের কালো। কালো সীমান্ত পেরিয়ে আলোর রাজ্যের মুক্ত সীমানায় বিশুদ্ধতায় মানবজীবনের পরিপূর্ণতা এনে দেয় শিক্ষা। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় কি ? এখানে কিসের চর্চার হয় ? বিশ্ববিদ্যালয় কোন সাধারণ প্রতিষ্ঠান নয় এখানে জাতীয় স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়, স্বপ্নের লালন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো সাধারণ জনগণের সেনানিবাস, বিশ্বাসের জায়গা,স্বপ্ন সম্ভাবনার বিনির্মাণ কেন্দ্র। এখানে চর্চা হয় শিক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্য-শিল্পকলা আর মানব জীবনের সার্বিক প্রস্তুতির। বিশ্ববিদ্যালয় হলো মানব সম্পদ মেরামতের কারখানা। শিক্ষা প্রাপ্তি মানুষের অধিকার। আমাদের দেশ বর্তমান উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করেছে কিন্তু বাস্তবে কী এর প্রতিফলন হচ্ছে। শিক্ষা ও উন্নয়ন একসূত্রে গাঁথা। শিক্ষার পরিবেশ ও মান বলে দেয় দেশীয় শিক্ষার হালচাল।

 

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কিসের চর্চা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষা বলা হয়। উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায় তা নিশ্চয়ই সবার জানা আছে আর জানা না থাকলেও কিছুটা হলেও অনুভবযোগ্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে সীমাবদ্ধ। উচ্চ পর্যায়ের কোন গবেষণা হয় না বরং শিক্ষার্থীরা মুখ খুঁজে থাকে একাডেমিক পড়ায় এবং এমপি থ্রিসহ নানা গাইড বইয়ের পাতায়। দেশের সিংহভাগ তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ এখন সরকারি চাকরির দিকে। জীবন ধারণের জন্য চাকরী জরুরী তবে এর চেয়ে বেশি জরুরী মনের জাগরণ।

 

মনের জাগরণ, সুস্থ ধারায় সংস্কৃতি চর্চা, পাঠ বহির্ভূত বিশ্ব সাহিত্য গ্রন্থ অধ্যয়ন ব্যতীত শুধু তোতা পাখির মুখস্থ বুলিতে ভালো চাকরি পাওয়া যায় কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা এখানে অর্জিত হয় না। যদি এখানে পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জিত হয় তবে বাস্তবে এ শিক্ষার চর্চা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ভাবনা-চিন্তা বিভিন্ন ধারার মানুষ হয়ে থাকে। কারো চিন্তার জগত বিশাল আবার কারো ভাবনা-চিন্তার গন্ডি ব্যাঙের কুয়োর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ভবিষ্যত মেরামত হয়। এখানে মানব সম্পদের মেরামত চলে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষার নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা একটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে কোন ধরণের বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ব নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাঝে প্রতিফলিত গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরের হালচিত্র ওঠে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রক্রিয়ায়। আমাদের শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে গলদ আছে। প্রাথমিক স্তরে বোর্ড পরীক্ষার কোন অর্থ নেই। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের আনন্দ সঞ্চার করাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে আমাদের কী লাভ হচ্ছে সেটা নিয়ে ভেবে দেখুন আমাদের অভিভাবক মহল। একটি উদাহরণ দেই। রাদিয়াত নামে একটি ছেলে প্রাইমারি স্তরে গ্রামের একটি স্কুলে পড়ে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার রোল কত ? সে বললো ২৯।

যখন সে তার রোল বলল তখন তার মুখটা বড় মলিন দেখাচ্ছিল। প্রাইমারি স্তরে যারা পড়ে তাদের বয়স একদম কম, এসময় তারা গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠার এই সময়ে রোল আগে পিছের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়া মানে পরীক্ষায় লিপ্ত করা ঠিক নয়। এ স্তরে শিক্ষার্থীদের শিখাতে জীবনমুখী শিক্ষার বেসিক ধারণা দিতে হবে, হাইজিন টিচিং, শিষ্টাচার র্চচা সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নাম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু তাদের নিয়মের বেড়াজালে রেখে পড়ানো হচ্ছে, রোল নাম্বার প্রথম দিকে থাকতে হবে,পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পেতে হবে। এ সব করে আমরা কী খুব বেশি লাভবান হচ্ছি। আমাদের এইসব বিষয় নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির আয়নায় এই রূপ দেখা দরকার, ভাবা দরকার। প্রাথমিক স্তরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের যোগ্যতা মেয়েদের জন্য (এইচ.এস.সি/ ডিগ্রি/অনার্স) এবং ছেলেদের জন্য ডিগ্রি/অনার্স)। অতীতে যারা প্রাইমারিতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের অনেকের যোগ্যতা ছিল এস.এস.সি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় হয়তো তারা যোগ্য তাই স্কুলে পাঠদান কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এভাবে নি¤œস্তরের শিক্ষা দিয়ে যেভাবে শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করা হবে এর প্রতিফলন হয় শিক্ষার পরবর্তী স্তরে, শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে, জীবনের সকল পর্যায়ে। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নিয়োগে আমাদের ভাবা প্রয়োজন। শিক্ষকদের নিয়োগ কাজ স্বচ্ছ এবং নির্মোহভাবে করতে হবে। আগ্রহীদের এ পেশায় নিতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় সিংহভাগ আসে জীবনে কোন কিছু করতে না পেরে। সিলেটের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। পথে কয়েকজন ছোট ছোট ছেলেদের পাই। এদের কেউ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে আবার কেউ ২য় শ্রেণিতে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচত হই। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম তারা কোন স্কুলে পড়ে এবং তাদের স্কুলে কেমন পড়ায়। তারা বললো ভালোই পড়ায়…। কেমন ভালো পড়া সেটা পরখ করার জন্যই কিছু সহজ প্রশ্ন করি।

যেমন কমলা শব্দের ইংরেজি কি বল দেখি। হোয়াটস ইওর নেইম ? এরকম বেশ কিছু সহজ প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু আশানুরূপ উত্তর পাইনি। তখন তাদের জিজ্ঞেস করি তোমার কি নিয়মিত স্কুলে যাও ? তারা বললো আমরা নিয়মিত যাই, ক্লাসও করি। এখন এখানে প্রশ্ন ওঠবে যে তারা যদি নিয়মিত স্কুলে যায়, ক্লাস করে তাহলে এসব সহজ প্রশ্নের উত্তর কেন দিতে পারলো না ? এর উত্তর হতে পারে ক্লাসে তারা ঠিকমতো মনোযোগ দেয় না, বুঝতে পারে না অথবা শিক্ষক ঠিকঠাক পড়াননি। এসব হচ্ছে আমার অনুমান। ভুল হতে পারে আবার বাস্তবে যদি খতিয়ে দেখেন তাহলে কারণগুলো মিলে যেতে পারে। বাচ্চারা এইসব সহজ প্রশ্ন উত্তর দিতে পারেনি তার প্রধান দুটি কারণ হলো

১। শিক্ষক তাদের ঠিকমতো পড়ান ২। শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পড়ে না, মনোযোগ দেয় না।
এরকম দৃশ্যের অবতারণা বাংলাদেশের অধিংকাংশ গ্রামাঞ্চলের প্রাইমারি স্তরে। শুধু গ্রামাঞ্চল নয় বাংলাদেশের শহর নগরে শিক্ষার করুণ দশা কেননা শিক্ষা এখন সবার কাছে ব্যবসা। শিক্ষা একটি চক্রাকারে ঘুরে, একটি স্তর অন্য স্তরের সাথে সম্পৃক্ত। প্রাথমিক স্তরের ব্যর্থতাই কিন্তু ধরা দেয় শিক্ষার উচ্চস্তরে। ফুল ফোঁটার পূর্ব হতে এবং ফুল ফোটার পর যদি কোন গাছের যতœ ঠিকমতো না নেওয়া হয় তখন সেই গাছ ধীরে ধীরে মরে যেতে শুরু করে তখন আর সুন্দর চিত্তাকর্ষী ফুল ফোঁটায় না। শিক্ষার ব্যাপার একদম ফুল গাছের বেড়ে ওঠা এবং ফুল ফোঁটানোর মতো। শিক্ষার সূচনা স্তর হতে উচ্চ স্তর পর্যন্ত যদি যতœ নেয়া তাহলে শিক্ষার ফুল হবে তরতাজা, ফল হবে সুমিষ্ট, জাতি হবে উন্নত।

আমাদের উন্নয়ন হবে কি করে আপনারাই ভেবে দেখুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া একধরণের ত্রুটিপূর্ণতায় পরিপূর্ণ এবং পরীক্ষা পাশের পর বিষয় বন্টন ভাগও হয়ে থাকে সনাতনী প্রক্রিয়ায়। এমসিকিউ পরীক্ষা আর নম্বর প্রাপ্তি দিয়েই যদি শিক্ষার্থীদেরকে মূল্যায়ন করা হয় এবং এর আলোকে বিষয় ভাগ বন্টন করা হয় তখন কিন্তু শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য অর্জিত হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। নির্দিষ্ট সংখ্যক পরীক্ষার্থী পাশ করে এবং তাদের ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় দেয়া হয় যা কখনো শিক্ষার্থীর পছন্দের আবার কখনো অপছন্দের চরম বিরক্তির। পছন্দ আর অপছন্দের মারপ্যাচে শুরু হয় উচ্চশিক্ষার যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরণের বিষয় থাকে। শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহের এবং পরীক্ষার ফলের উত্তর ভিত্তি করে একটি বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। এখানে আমাদের ভেবে দেখা উচিত আমাদের শিক্ষার্থীদের আমরা যে বিষয়ে পড়ার সুযোগ করে দিব তারা সেই বিষয়ে গড়ে ওঠবে, দক্ষ হবে এবং দেশের কাজে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ এবং আমাদের প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের আলোকে শিক্ষায় সুযোগ দেয়া হয় তাহলে আমাদের দেশের কল্যাণ হবে, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাবে। মানুষের জীবন মান উন্নয়নের মহাযাত্রায় পথ চলবে সদর্পে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বাস্তব চিত্র দেখা যাক। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিপুল অর্থ ব্যয় করে এবং মানসিক অস্থিরতায় একটা বন্ধুর পথ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও সুযোগ অর্জন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যে বিষয় সুযোগ পায় তা তাদের আগ্রহে নয়। বর্তমান এই জনসংখ্যার বিস্ফোরণের যুগে কোন একটি বিষয়ে সুযোগ পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার মতো তাই ছেড়েও যায় না, প্রথাগত ধারায় শিক্ষা অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনগুলিতে শিক্ষার্থীরা ভাবনার দোলাচলে দিন পার করে। কেউ টিউশন করে কিংবা বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়াশোনার খরচ চালায়।

মানসিক অস্থিরতা আর সমাজে চলাচলের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হিমশিম খায় একজন নবীণ শিক্ষার্থী। চোখে শুধু দেখে প্রতিযোগিতার দৌড়, নেই কোন শান্তির শীতল হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের পথে অনেক জীবনের না জানা গল্প লুকিয়ে থাকে। যে গল্পগুলো বিষাদের, অশ্রু ঝরার, নিজের পছন্দ- আগ্রহের ক্ষেত্র নিজহাতে জলাঞ্জলি দেয়ার। একজন শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করবে তা নির্ধারণ করে পরিবার, শিক্ষক, সমাজ এবং বিশ্ববাজার অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে। বিশ্ব অর্থনৈতিক বাজার এবং দেশীয় চাকুরির বাজারের গ্রহণযোগ্যতার চিত্র দেখে নির্ধারণ করা হয় ঐ হয় বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতা, সফলতার রূপরেখা। ভালো বিষয়, মন্দ বিষয় এটি একটি দুষ্ট চক্র। আমাদের শিক্ষার্থীরা যেমন এ দুষ্ট চক্রের শিকার, শিক্ষকরাও এর শিকার। যে শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনে তার কাছে তার বিষয়কেই সেরা মনে মনে কেননা সে জানে বৈশ্বিক অর্থ বাজারে তার মূল্যমান।

আবার আরেকজন শিক্ষার্থী যে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ভাষাতত্ত্বে পড়ালেখা করছে তাকে ঘরের ভেতর কিংবা বাহিরে প্রায়ই শুনতে হয় ‘ এ যুগে তো কেউ ভাষা কিংবা সাহিত্য পড়তে চায় না। এসব পড়ে তো কিচ্ছু হবে না…।’ আমাদের দেশে আরবী ভাষা তত্ত্ব অধ্যয়ন করার এদের ভবিষ্যত কী শুধু আরবী ভাষা নয় যেমন আরো আছে উর্দু ভাষা, পালি ভাষাসহ এমন কিছু বিষয় পড়ানো হচ্ছে কিন্তু এদের বিষয় সংশ্লিষ্ট ভবিষ্যত কী আমরা ব্যবস্থা করতে পেরেছি ? শুধু পড়িয়ে তো দায়িত্ব শেষ না বরং এই চারবছর মেয়াদী কোর্স শেষে যদি তাকে যদি যথাযথ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা না হয় তাহলে তো রাষ্ট্রের বৃহত্তর ক্ষতি সাধিত হলো। মানুষের জীবনে সুপিরিয়রিটি ইনফেরিয়রিটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার আদিকাল হতে মানুষের মাঝে ভালো মন্দ, উচ্চ বর্ণ- নি¤œ বর্ণ নিয়ে বিভেদের দেয়াল আজো বিদ্যামান। বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক প্রতিষ্ঠানে যেখানে চর্চা হবে জ্ঞানের , প্রার্থনা হবে নতুন কিছু জানার, বুঝার এবং প্রয়োগ করার অথচ বাস্তব প্রেক্ষাপটে দেখে আসুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রখানা। বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ বলুন সবই যেন আহমদ ছফার লেখা কালজয়ী উপন্যাস ‘গাভী বিত্তান্তের’ একটি বাস্তব প্রামান্যরূপ। যে রূপে এখন দেখা মিলে স্বার্থ কেন্দ্রিকতা, অসুস্থ সংস্কৃতির র্চচা, প্রেম ভালোবাসার নামে যৌনাচার, তোষামদ, লেজুরবৃত্তি, ভ-ামি আর জ্ঞানপাপের পাপীদের রমরমা মিলনমেলা।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ মানব সম্পদ। দেশের অর্থনৈতিক শক্তি কিংবা রাজনৈতিক শক্তি তারাই রক্ষা করে অদৃশ্য অবস্থান হতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান,একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নতুন করে ভাবতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। চিন্তার জগতে বুদ্ধিবৃত্তির ধারায় নিয়ে আসতে হবে।এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবক মহলের হাতে ন্যস্ত। অভিভাবকরা তাদের শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য শিল্পকলাসহ নানা শাখায় তাকে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বুঝবেন, পঠিত বিষয়ের সাথে বাস্তবে প্রয়োগের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। জ্ঞানের সকল বিষয়ই একটি আরেকটির সাথে বিভিন্নভাবে সম্পর্কিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় পড়ে সেসবের সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার নি¤œস্তর থেকে শুরু করে উচ্চস্তর পর্যন্ত শেখানো হয় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে একটা চাকুরির জন্য। যখন শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হয় চাকরি প্রাপ্তি তখন শুরু হয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জিত না হওয়ার ফলে সমাজে লেখা হয় অন্ধকার হতাশার গল্পকথা। আমরা এখন শিক্ষার্থী পাচ্ছি না, আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন কর্পোরেট দাস। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করে না, নিজ নিজ চিন্তা ভাবনা, মননের পরিবর্তনের জন্য। কর্পোরেট সমাজ ব্যবস্থার সাথে সহজে চালচলন করার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করে। আমাদের শিক্ষার্থীদেরমনওে জগত নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেট লর্ডরা। চটকদার বিজ্ঞাপন এবং উচ্চ জীবনের ব্যানারে হারিয়ে যায় আমাদের শিক্ষার্থীদের মনের জাগরণ। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির বাজার শিক্ষার্থীর চিন্তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। চিন্তা বিকাশের পথই যখন রুদ্ধ তখন ব্যক্তির উন্নয়ন বলি আর রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে কোথায়।

যখন ব্যক্তির উন্নয়ন হয় না তখন একটি রাষ্ট্রের জাতীয় উন্নয়ন হয় না কেননা ব্যক্তিই তো জাতীয় উন্নয়নের মানব সম্পদ। শিক্ষার প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য , দর্শন নিয়ে ভাবুন শিক্ষার্থীরা এখন খুবই কম আছে। তারা ভাবছে পরীক্ষায় ভালো করা আর শিক্ষাশেষে একটি চাকরি পাওয়া। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে শুধু ভাবনা তুমি কি করবে, তুমি কতদূর এগিয়েছো, অযথা ভেবো না, আগে নিজেকে গড়ো। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এভাবে ছুটে চলছে। সবাই যখন নিজেরটা নিয়ে ভাবছে তখন সমস্যার সূত্রপাত। বিশ্ববিদ্যালয় মেধামনন, সৃজনশীলতা, নৈতিকতা তৈরির একটা কেন্দ্রীয়মহল। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষা বলা হয়। আমাদের দেশে নামমাত্র শুধু উচ্চশিক্ষা আছে। গবেষণা কর্ম ব্যতীত বিশ্বের কোন দেশেই উচ্চশিক্ষার আহামরি তাৎপর্য নেই। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার সুযোগ শূণ্যের ঘরে। শিক্ষকদের নির্দিষ্ট স্লাইড, বগলদাবা লেকচার শিট, ক্লাস, সেমিনারে সীমাবদ্ধ উচ্চশিক্ষা আর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। গবেষণা কর্ম হচ্ছে সত্য অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তব যেকান সমস্যার সমাধান করা যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যায় জর্জরিত। এক্ষেত্রে গবেষণা করা গেলে সত্য কারণটি জানা যেত এবং সেই আলোকে সমাধানের রূপরেখা অঙ্কিত হতো। গবেষণা কর্মের জন্য বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। বাজেটের অভাবে অনেক উৎসাহী শিক্ষক- শিক্ষার্থী গবেষণা কর্ম করার কোন সুযোগ পাচ্ছেন না। যার ফলে আমাদের রাষ্ট্রের বৃহৎ ক্ষতি হচ্ছে হয়তো সেটি আমরা বুঝতে পারছি না। একটা সময় ঠিকই এর জন্য মূল্য দিতে হবে অনেক কিছুর বিনিময়ে। শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা মানের নানা মনের শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন।

কেউ নিজেকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিবেদিত একদম নি:স্বার্থভাবে নিরলসভাবে কাজ করে যান আবার আরেক শ্রেণির শিক্ষক আছেন যারা যুক্ত আছেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে। এক বা একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ আয়ের মহালীলায় নিজের নাম যুক্ত করেন। বর্তমান শিক্ষায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের মহান যে ভাব , মনমানসিকতা সেটি গড়তে পারছেন না। প্রায়ই একটা শুনি- কাউকে শেখাতে গেলে শিখা হয়, গড়তে গেলে নিজেকে গড়া হয়। আমাদের শিক্ষকরা কি এখানে ব্যর্থ নন ? শুধু আমাদের শিক্ষকরা ব্যর্থ বললেই সব সমাধান হবে না।

শিক্ষকদের ব্যর্থতার জন্য তাঁরা যতটা না দায়ী এর চেয়ে বেশি দায়ী শিক্ষার নীতি নির্ধারকরা। শিক্ষকতা একটি সৃজনশীল পেশা। শিক্ষকতা পেশায় সৃজনশীলতার চর্চা এক অপরূপ স্থান কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতায় সৃজনশীলতা, মননশীলতার চর্চার সুযোগ নেই। রসকসহীন সাদামাটা প্রক্রিয়ায় শিক্ষা এখন শুধু সনদমুখী ব্যবসা যা আমাদের শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের আন্তঃব্যক্তিক স্থাপন প্রক্রিয়াকে নিয়ে গিয়েছে হাঁটবাজারের আসা যাওয়া ক্রেতা-বিক্রেতায় সারিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় চলছে হতাশা আর দুর্দশা। অল্প ক’টি সাফল্য দিয়ে সমগ্র জাতির মূল্যায়ন এক ধরণের পুতুল খেলা।

প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যোগ্যতাগুণে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার সকল স্তর পেরিয়ে তারা এখানে আসে জ্ঞানের পরিপূর্ণতার অর্জনের জন্য। এরপর শুধু পড়াশোনার চাপ, ইনকোর্স, সেমিনার, সেমিষ্টার ফাইনালসহ নিজের অর্থখরচ সংগ্রহ করার প্রাইভেট পড়ানো। সামজিক প্রত্যাশার পাহাড়সম চাপ, নিজের অস্তিত টিকিয়ে সব মিলিয়ে বোবাকষ্টের নোনাজলে ডুবে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ব্যক্তিগত চাহিদা আর সামাজিক চাহিদার যাতাকলে নিষ্প্রেষিত শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা মানে মুক্তি, শিক্ষা মানে আনন্দ। নিজেকে জানার, বুঝার মাঝেই রয়েছে মুক্তি, মুক্তির মাঝেই রয়েছে আনন্দ। একজন শিক্ষার্থীর জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের রাজ্যে মুক্ত আঙিনায় বিচরণ করে প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। বিচরণ পথে সহায়তাকারী হয়ে ওঠেন শিক্ষক। দেশের শিক্ষার মান প্রকৃত উন্নয়ন হলেই জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হবে।

ইতিবাচক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পূবালী হাওয়ায় শীতল করে যাবে আমাদের অস্থির চিন্তার জগৎ এবং আমাদের জীবনধারা। মোতাহের হোসেন চৌধুরী ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে বলেন “ জাতির জীবনধারা গঙ্গা-যমুনার মতো দুই ধারায় প্রবাহিত। এক ধারার নাম আত্মরক্ষা বা স্বার্থ প্রসার, আরেক ধারার নাম আত্মপ্রকাশ বা পরার্থ বৃদ্ধি। একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, মামলা ফ্যাসাদ প্রভৃতি কর্দয দিক, অপর দিকে সাহিত্যশিল্প, ধর্ম প্রভৃতি কল্যাণপ্রদ দিক। একদিকে শুধু কাজের জন্য কাজ, অপর দিকে আনন্দের জন্য কাজ। একদিকে সংগ্রহ, আরেক দিকে সৃষ্টি। যে জাতি দ্বিতীয় দিকটার প্রতি উদাসীন থেকে শুধু প্রথম দিকটির সাধনা করে, সে জাতি কখনও উঁচু জীবনের অধিকারী হতে পারে না। কোনো প্রকারে টিকে থাকতে পারলেও নব নব বৈভব সৃষ্টি তার দ্বারা সম্ভব হয় না।

মানসিক ও আত্মিক জীবনের সাধনা থেকে চরিত্রে যে শ্রী ফুটে ওঠে, তা থেকে তাকে এক রকম বঞ্চিত থাকতেই হয়। জীবনে শ্রী ফোটাতে হলে দ্বিতীয় দিকটির সাধনা আবশ্যক। আর সে জন্য লাইব্রেরি এক অমূল্য অবদান”। কি সুন্দর তাঁর এই কথাগুলো। আমাদের জীবনে কি আমরা শ্রী ফোটাতে পারি ? জীবনে শ্রী ফুটানোর যে চর্চার পথ সে পথ এখন শুধু ক্ষুদ্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনের মাঝে একটু আলোতে একটু আঁধারে ছুটে চলেছে। বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা এখনো লাইব্রেরিমুখী তবে তা শুধু কর্মের জন্য, বিসিএস পরীক্ষার জন্য, একাডেমিক পরীক্ষার জন্য, জীবনে আনন্দের জন্য নয়, জীবনে শ্রী ফুটানোর জন্য নয়। বেলা বয়ে যায়,সূর্য ডুবে যায় দিগন্তের নীলিমায় এই প্রত্যাশায় যে আগামীর সুন্দর ভোরে মিষ্টি আলোর দূত হয়ে ওঠবে পূবের আকাশে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে, এখনই শ্রেষ্ঠ সময় ভাবার, পরিবর্তন সূচনা করার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষার সকল স্তর নিয়ে ভাবতে হবে কেননা একটি আরেকটির সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমাদেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। পরিবর্তন একদিনে সম্ভব নয়, পরিবর্তন করতে হলে নিতে হবে সুদীর্ঘ পরিকল্পনা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সুপরিবর্তনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তথা উচ্চশিক্ষার পরিবর্তন হবে। আমাদের ভাবনার মাঝেই মিলবে মুক্তি, হবে পূর্ণ সমাধান। সেই মুক্তির আলো ফুটে ওঠবে দিগন্তের র্প্বূরেখায় নতুন সম্ভাবনায়, আলোকিত হবে আমাদের শিক্ষার্থী, আমাদের দেশ, আমাদের পৃথিবী।