দক্ষিণ সুনামগঞ্জে দিশেহারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ৯:০২ অপরাহ্ণ, জুলাই ২২, ২০২০ 512 views
শেয়ার করুন
সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তৃতীয় দফায় বন্যা আক্রান্ত উপজেলা বাসী।
 
চটপটি বিক্রেতা জসিম উদ্দিন। উপজেলার নোয়াখালি বাজারের কৃষি ব্যাংকের সামনে সব সময় বসে চটপটি বিক্রি করেন। তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ ছয়জনের সংসার চালান তিনি। বয়স আনুমানিক ৪০ বছর হবে। অসুখ-বিসুখ না হলে জীবনের একটি দিনও বসে কাটাননি কখনো। ঈদের দিনেও তাকে রাস্তাঘাটে বাজারে চটপটির পসরা সাজিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। জীবনের সব স্বাধ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে যে মানুষটি হরদম পরিশ্রম করে সংসার চালিয়েছেন অনায়েসে, সেই মানুষটিই এখন বলতে গেলে কর্মহীন। কঠোর লকডাউন থাকাকালীন কাজহীন হয়ে থেকেছেন গৃহবন্দি, চলেছেন ধার দেনা করে। বাজারে দোকান বসানোর অনুমতি পাওয়ার পর সপ্তাহ খানেক বেচাকেনা করলেও আগের মতো ব্যবসা হচ্ছিলো না তার। আকস্মিক বন্যায় ব্যবসা ঠিকমতো শুরুও করতে পারেননি তিনি। বন্যায় চারদিকে মানুষ ঘরবন্দি হয় পড়ে। কষ্টে করে কোনও রকমে দিন পাত চললেও বন্যার পানি চলে যাওয়ায় নতুন করে ব্যবসায় প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু তা আর শুরু করতে পারেননি। তিনদিন পর আবার দ্বিতীয় দফা বন্যা। দীর্ঘদিন থেকে যায় বন্যার পানি। বাজারে লোকজন আসতে না পারায় ব্যবসায়ও জমছিলো না তার। দ্বিতীয় দফার পানি কমতে না কমতেই আবারও তৃতীয় ধাপে বন্যা। মানুষ একেবারেই বাজারে আসছেন না। আসলেও কোনো রকমে তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে যত তারাতারি সম্ভব বাড়ি ফেরা। জসিম উদ্দিনের চটপটির দোকানে এখন আর কেউ ভিড় করে না।
 
বুধবার বিকাল ৪টায় বায়ান্ন টিভির প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ভাইরাস আর বন্যায় কাস্টমার একেবারেই কমে গেছে। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে আড়াই তিন হাজার টাকা বিক্রি করা যেতো এখন ৭শ থেকে ৮শ টাকার বিক্রি হয়। আমার ঘরে হাঁটুজল। তৃতীয়বারের মতো ঘর ছাড়তে হবে। গ্রামীণব্যাংকে একটি ঋণও আছে। সব নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি।
 
চা বিক্রেতা লিটন দেব। স্ত্রী আর দুই পু্ত্র সন্তান, মা-বাবা বোন নিয়ে সাত জনের মাঝারি রকমের সংসার তার। লকডাউনের সময় দোকান পাট বন্ধ করে কোনও রকমে চালান সংসার। অভাবের সংসারে একামত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই। অন্যান্য দোকানদারের দোকানে দোকানে চা দিয়ে মোটের উপর ৩শ থেকে ৫শ টাকা প্রতিদিন উপার্জন করেন তিনি। করোনার কারণে লকডাউন, দফায় দফায় বন্যা পরিস্থিতির চরমাবনতি ও বাজারে তুলনামূলক মানুষের উপস্থিতি কম হওয়ায় বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমেগেছে তার। উপর্জন কমে যাওয়ায় পূঁজি ভাঙিয়ে চালাচ্ছেন সংসার। বারছে ঋণের পরিমান। রীতিমতো দিশেহারা তিনিও।
 
এতো গেলো দুই ব্যবসায়ীর গত একমাসের যাপিত জীবনের গল্প। এ গল্প দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শিমুলবাক ইউনিয়নের শিমুলবাক বাজারের চা বিক্রেতা আবদুল আলীম ও মুদির দোকানি মুহিবুর রহমান মানিক, জয়কলস ইউনিয়নের শান্তিগঞ্জ বাজারের স্টেশনারি ব্যবসায়ী সাদিকুর রহমান খোকন, পাথারিয়া বাজারের বিস্কুট বিক্রেতা দিলশাদ মিয়া, পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চিকারকান্দি বাজারের ঝালমুড়ি বিক্রেতা হারুন মিয়া, পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের ব্রয়লার মোরগ বিক্রেতা ফয়জুল হক ও দরগাপাশা ইউনিয়নের ছয়হারা ব্রিজ সংলগ্ন মৌগাঁও, বাঘেরকোনা ও টুকেরবাজার পযেন্টের টং দোকানদার আবদুস সোবহানের।
 
এভাবেই ভিতরে হা-হুতাশ ছাপা দিয়ে প্রতিটি দিন যাপন করছেন এ উপজেলার অসংখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যখন পেরে উঠবার নয়, তখন নিয়তির উপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা নিম্ন আয়ের মানুষদের। তবে- এসবের মধ্যে যদি কিছুটা সরকারি অনুদান পান তাহলে একটু হলেও জিড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ হয় তাদের। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন। ব্যবসায়ী নাম থাকায় সকলের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের উপর থেকে। স্থানীয় সরকারের কিছুটা সহায়তা পাওয়ার আশা উপজেলার বিভিন্ন বাজার, পাড়া-মহল্লা বা গ্রামের মোড়ে থাকা নামমাত্র এসব ব্যবসায়ীরা।
 
চিকারকান্দি বাজারের চানাটুরসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রেতা হারুন মিয়া জানান, `ব্যবসা বাণিজ্য ভালো হচ্ছে না। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মানুষ বাড়ি থেকেই বের হতে পারছে না, চানাচুর খাবে তো দূরের কথা।’
 
দরগাপাশা ইউনিয়নের ছয়হারা ব্রিজ সংলগ্ন মৌগাঁও, বাঘেরকোনা ও টুকেরবাজার পযেন্টের টং দোকানদার আবদুস সোবহান বলেন, `আমার দোকানে বিস্কুট বিক্রি করি। মানুষের মনে শান্তি নাই। ঘরবাড়ি পানিতে ডুবানো। মনে সুখ থাকলে মানুষ চা খাবে? ব্যবসা একেবারেই হচ্ছে না।’
 
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেবুন নাহার শাম্মী বলেন, `আমরা উপজেলাব্যাপী বন্যার্তদের খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা দরিদ্র বন্যার্ত হলে তারাও ত্রাণ পাবেন।’