সামাজিকীকরণে ব্যক্তি ও তার পরিবারের ভূমিকা অপরিহার্য
মোহাম্মদ কয়েছ আহমেদ মোহাম্মদ কয়েছ আহমেদ
বিয়ানীবাজার, সিলেট
সামাজিকীকরণের কতগুলো মাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে পরিবারের ভূমিকাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বংশগতি কাঁচামাল জোগায়, সংস্কৃতি নকশা জোগায় এবং পরিবারে পিতা-মাতা কারিগর হিসেবে কাজ করেন। কারণ শিশুর দৈহিক, মানসিক, পার্থিব ও অপার্থিক যাবতীয় প্রয়োজন মেটায় পরিবার।সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সমাজের সাথে পরিচিত হয়, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও ভাবধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। সমাজবিজ্ঞানী Bogardus এর ভাষায়, ‘সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি জনকল্যাণের নিমিত্তে একত্রে নির্ভরযোগ্য আচরণ করতে শেখে এবং এটি করতে গিয়ে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্বশীল ও সুসামঞ্জস্য ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে।’ অর্থাৎ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ সমাজে প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও ভাবধারা ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
সামাজিকীকরণ শিশুদের সামাজিক আচরণ শিক্ষা দেয়। সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি রাজনীতির সাথে পরিচিত হয় এবং ব্যক্তির মধ্যে চেতনা ও মেধার বিকাশ ঘটে। ব্যক্তির মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ধারণা জন্ম নেয়। দেশগঠন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সকল প্রকার সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং রাজনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে তাদের সঠিকভাবে সামাজিকীকরণ হচ্ছে কি ? অত্যাধুনিক চিন্তাচেতনার বেড়াজালে বেড়ে উঠতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম সঠিক পথ পরিহার করে বিপথে পরিচালিত হলে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় তারা ব্যর্থ হবে। ভেঙে যাবে সামাজিক কাঠামো। সামাজিক অস্থিরতা, পারস্পরিক সহিংসতা ও সন্ত্রাস, দুর্নীতি, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ়। সমাজিক মূলবোধের প্রাধান্য এ সমাজের ঐক্যের মূল হাতিয়ার। সামাজিক দায়বদ্ধতা সমাজ তথা দেশ বিনির্মাণে বড় ভূমিকা রাখছে। এ সমাজের মানুষ শুধু আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, নৈতিক মূল্যবোধও এদের কাছে অধিক সংবেদনশীল। কিন্তু আজকে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম কি সামাজিক দায়বদ্ধতা বা নৈতিক মূল্যবোধের দীক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে ? যদি না হয় তবে আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখছি তা স্বপ্নই থেকে যাবে। সামাজিকীকরণের প্রধান ক্ষেত্র পরিবার।
পারিবারিক শিক্ষা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি শিশুর পরবর্তী জীবনে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের সমাজে যখন যৌথ পরিবার ছিল তখন পরিবারেই শিশুরা সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করত। নানামুখি অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা পেত। বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা পেত। সমাজের সাথে তার যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সেই উপলব্ধি জন্মাতো পরিবারেই। নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও সামাজিক মূল্যবোধের ধারণা লাভ করে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হত। তাদের মধ্যে জন্ম নিত সামাজিক দায়বদ্ধতা। যৌথ পরিবারের নানা সমস্যাও ছিল। সেই সমস্যা সমাধানে পরিবারের যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাঁদের ভূমিকা এবং সমস্যা সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ, সমাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয় শিশু কিশোরদের মধ্যে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের পথ সুগম করেছে। পরবর্তী সময়ে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের জন্ম হলেও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের প্রাধান্য ছিল। একাধিক ভাই- বোন থাকায় ভাগাভাগি করে নেয়ার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়নি এ সময়ের সন্তানেরা। সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকেই পেত, যা সমাজ এবং দেশ গঠনের জন্য অপরিহার্য্য।


