গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। সুশাসন নিশ্চিত করতে স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য। দেশের সঠিক চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে, তাই স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে গণমাধ্যমের। আমরা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। এটি দেশ হোক বা প্রবাস হোক। যদিও প্রবাসে সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নানাবাধ্যবাধকতায় পেশাদারিত্ব এখানে রাখাটা কঠিন। তবুও কেউ কেউ করে যান। আর এই কেউ কেউ থেকে শিখে নানাজন।
প্রবাসে সাংবাদিকতায় উন্নয়নশীল সাংবাদিকতাই মূলত মূখ্য। এখানে সাংবাদিকতার প্রধান কর্ম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বা অপকর্ম তুলে ধরার সুযোগ খুবই কম। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নানারকম নিয়ম আর আইনের কারণে তা অসম্ভব। তাই ৪র্থ রাষ্ট্র যে অর্থে বলা হয় প্রবাসে সে বিষয়টি গৌণ হিসেবে বিবেচিত। তবে প্রবাসের যাপিত জীবনের নানাদিক সমস্যা আর সম্ভাবনার দিকগুলোকে অনেকে অনুসন্ধানী ভাবে তুলে ধরতে পারছেন। প্রবাস থেকেও তারা দেশেল প্রথমসারির সাংবাদিকের মতো কাজ করছেন প্রতিনিয়িত। সমষ্টির কষ্টগুলো বা একার সাফল্য তখন সবার সাফল্যে হাতছানি দিয়ে ডাকে তারাভরা জোছনায় বা অন্ধকারের অমাবশ্যায়। দেশে থাকতে দেশের প্রথম সারির পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। বাংলাদেশ ও ভারতে ছোটখাটো সাংবাদিকতার পেশাগত মান উন্নয়নে কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে শিখেছিলাম সব খবরই খবর হয় না। অথবা ছোট অদেখা জিনিসও খবর হতে পারে। কী সংবাদ হতে পারে আর কী হতে পারে না তা নিয়েও শিক্ষা নিয়েছিলাম। সংবাদ দ্বারা কোন জাতি, গোষ্ঠিকে হেয় করা তো যাবেই না এমন কী ধর্ষিতার নাম পরিচয় গোপন রাখার কথা বলা হয়েছে। আর ধর্ষকের পরিচয় ছবি ছাপিয়ে এ কাজে নিরুৎসাহিত হবার শিক্ষা দেয়া হয়েছিলো আমাদেরকে। কিন্তু আফসোস, আজকাল সস্তা টিআরপি বলি আর অনলাইন রেংকিং বলি ধর্ষণের নিউজে রংমাখা শিরোনাম আর ধর্ষিতার ছবি ছাপা হয় দেখে নিজেকে লজ্জিত হতে হয়।
প্রবাসে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে আমার। দেশের প্রথম সারির টেলিভিশনে পেইড আর রিপোর্টার হবার সুবাধে টেলিভিশন সাংবাদিকতার নানা বাঁক শিখেছি। প্রতিনিয়ত শিখছিও। আমরা সাবজেক্ট আর অবজেক্ট আলাদা করে নিউজ করি। বিশেষ করে কোন ইভেন্ট হলে সেখানে সাবজেক্ট হয় কী উপলক্ষে বা কী নিয়ে হয়েছে সেটি। আর অবজেক্ট বা ইনসার্ট থাকে সেখানে উপস্থিত জনতার অংশ। তবে এখানে সাবজেক্টকে গুরুত্ব দেয়া লোকের সংখ্যা খুব কম। সবাই অবজেক্ট তথা নিজের নাম আর নিজের ছবিকে প্রাধান্য দিতে চায় এখানে স্বাধীন সাংবাদিকতা আহত হয়। তবে সবাই যে এমন তা নয়। এমনিতে অপরাধজনিত কোন অনুসন্ধানি কিছু এখানে করার সুযোগ নেই তার উপর বিশেষ প্রতিবেদনে পজেটিভ কিছু দেয়া গেলেও তা টিভি বা পত্রিকায় প্রবাসিদের জন্য জায়গা বা সময় কম থাকায় তাও হয়ে ওঠে না। তাই টিভিতে ভিও বা পত্রিকায় কলাম নিউজ হলেও লিংক নিউজটা ঠিক হলে একজন পেশাদার সংবাদকর্মী তার মনের খোরাক মেটাতে পারেন।

কমিউনিটির অনেকের অনুযোগ অমুকে তমুকে ফেসবুকে ইভেন্টের ছবি দেয় তুমি কেন দাও না? অনেকে আবার বলেন অমুকে/তমুকে তার একটা লগো আর ওয়েব লাগিয়ে জেপিজি ছবি বানিয়ে পত্রিকার কাটিংয়ের মতো দেয় তুমি কেন দাও না? আমি তখন হেসে চলে আসি। কী করে বুঝাবো একজন পেশাদার সংবাদকর্মী তো ইভেন্টের ১০০টি ছবি তার নিজের ফেসবুকে দিতে পারে না। পেশাদারিত্বের অংশ হিসেবে আমার নিজের বায়ান্ন টিভি পোর্টালে ২/৩টি ছবি যুক্ত করে সেই নিউজ লিংক নিজের ওয়ালে শেয়ার করি। যা পেশাদার মানুষেরা সকল পেশায় এভাবে তুলে ধরেন। এছাড়া যার ওয়েব নাই আবার ওয়েব এড্রেস ব্যবহার করেন অথবা জেপিজি বানিয়ে ছবি আকারে পোস্ট করেন আবার নেটে ওয়েব ঘাটিয়ে যারা পান নাই এটা পোস্টদাতার একান্ত ব্যাপার। একাত্তর টিভির নাবিক আমাদের বস মোজাম্মেল বাবু বলেছিলেন—এখন পাঠক বা দর্শক ঠকানো কঠিন। তারা একসাথে ৫টি চ্যানেল আর ৫টি পত্রিকার নিয়মিত পাঠক আর দর্শক। তাই পঁচামাল গিলানো বা ঠকানো মোটেই সম্ভব না। নিজেকে হতে হবে স্মাট আর ক্রিয়েটিভ।
দেশ বিদেশের অনেক সহকর্মীকে ‘গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব’ লিখতে দেখি। গণমাধ্যমকর্মী আর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব যে কী আকাশ পাতাল ফারাক তা ব্যাকরণ বা শব্দজ্ঞান যাদের আছে তারাই জানেন। প্রবাসে যতো টিভি বা পত্রিকার অনুষ্ঠান হয় তা টিভি বা পত্রিকা অফিস থেকে কোন টাকা দেয় না। এমনকি বেশিরভাগ সংবাদকর্মী বেতনই পায় না। কমিউনিটির মানুষের ভালবাসা আর সহায়তায় অনুষ্ঠানগুলো হয়। কমিউনিটির মানুষেরাই প্রবাসেও গণমাধ্যম আর গণমাধ্যমকর্মীকে বাঁচিয়ে রাখেন। তাই কমিউনিটির মানুষেরাই প্রবাসে গণমাধ্যমের রক্ষক আর পৃষ্ঠপোষক। আর দূতাবাস বা হাইকমিশন সংবাদকর্মীদের নানা প্রতিকূল পরিবেশে রক্ষা করেন। তথ্যসেবা দিয়ে সহায়তা করেন সময়ে সময়ে। আরেকটি বিষয় আমাকে দাগ কাটায় মনে। মাঝে মাঝে সংবাদকর্মীদের সাথে কমিউনিটির মানুষের অপ্রত্যাশিত ব্যবহার। যদিও আমার সাথে কারো এমন হয় নাই। বা সবার আমার সাথে অত্যন্ত সু সম্পর্ক। তবে সহকর্মী কয়েকজনের এমন অভিযোগ শুনেছি বা নিজেও দেখেছি। দেশে যখন সাংবাদিকতা করতাম তা ছিলো অত্যন্ত সম্মানের-মর্যাদার। কিন্তু প্রবাসে এটা মাঝে মাঝে কেন যে ঘটে তা বলতে পারি না। সংবাদকর্মীরা অবশ্যই সম্মান পাবার যোগ্য। যারা অন্যকোন কাজ ফেলে কমিউনিটি তথা প্রবাসিদের উন্নয়নের স্বার্থে দিনে রাতে কাজ করেন তারা অবশ্যই সম্মান পাবার যোগ্যতা রাখে। যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উচ্চারণ রাষ্ট্রদ্রোহি হয় তবে যুক্তিবিদ্যার ভাষায় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ এর লালকারীরা সকলের ভালবাসা আর সম্মানে থাকবে এটিই স্বাভাবি আশা। দূরদেশে অচিন তারার মতো কমিউনিটির একেক তাঁরারা একআকাশের তাঁরা হয়ে কাজ যেভাবে করছেন তার অব্যাহত যাত্রায় আরো এগুক সোনার বাংলা…


