প্রবাসী প্রসঙ্গ

প্রকাশিত: ৫:৩৩ অপরাহ্ণ, জুন ৮, ২০২১ 590 views
শেয়ার করুন

এই লেখাটি গত নির্বাচনের প্রাক্কালে লিখেছিলাম। নির্বাচনে আমরা প্রবাসীদের প্রসঙ্গ, আমাদের দাবী দাওয়া বরাবরই অনুপস্থিত থাকে। এবার বাজেট প্রাক্কালে প্রবাসীদের সমস্যা ও প্রয়োজনীয় দাবি দাওয়া নিয়েও তেমন কোন সাড়াশব্দ পাইনি। লক্ষ্যণীয় যে আমাদের প্রবাসী কমিউনিটিতেও তেমন আওয়াজ উঠেনি। নির্বাচন ও বাজেট ঘিরে যদিও দলীয় আলোচনা প্রচারণায় সরগরম থেকেছে প্রবাসী বিভিন্ন কমিউনিটি তথাপি প্রবাসীদের মূল বিষয় গুলো উত্থাপিত হয়নি।রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারেও প্রবাসী প্রসঙ্গ খুবই হালকাভাবে এসেছে। কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলো নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রবাসীদের বিভিন্ন ফোরামে এই ইস্যুগুলো দাবি হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি। একটু পরিবর্ধিত করে ইস্যুগুলো আবারো তুলে ধরলাম :

১. আয়কর – যদিও আমরা জানি যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আয়করমুক্ত কিন্তু এটি সর্বোতভাবে সঠিক নয়। শুধুমাত্র নিজের একাউন্টে টাকা পাঠালে তা নিজের জন্যে আয়কর মুক্ত কিন্তু বাবা মা অথবা ভাই বোনের একাউন্টে পাঠালে ঐ টাকা উনাদের জন্য আয়কর মুক্ত নয়। ১৯৮৪ সনের আয়কর আইনে এটি এভাবেই আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এটির একটি সুরাহা করেছে। ভারতের ১৯৬১ সনের আয়কর আইনে সংশোধনী এনে রেমিট্যান্সের প্রথম প্রাপকের জন্যেও আয়করমুক্ত করা হয়েছে। তাই বাবাকে একটি ঘর বানাতে টাকা পাঠালে উনাকে ঐ টাকার আয়কর দিতে হয়না। আমাদের আয়কর আইনও এমনিভাবে সংশোধন করা উচিত। এবারের বাজেটে প্রস্তাব করা হয়েছে যে গ্রামে বাড়ি বানালেও টিআইএন দেখাতে হবে, তার মানে ওনাদেরকেও আয়করের আওতায় আনা হবে। আমাদের সমাজে এখনো একান্নবর্তী পরিবার টিকে আছে, প্রবাসী ছেলের টাকায় পরিবারের জন্য একটি ঘর হবে এটিই স্বাভাবিক, তবে এই নূতন বিধি একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

২. প্রবাসী কল্যাণ তহবিল – আইনের মাধ্যমেই এই তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ নিয়ে গেজেটও হয়েছে। তহবিলের অর্থ প্রবাসীদের থেকেই সংগ্রহ করা হয়। কোন কোন খাতে এ টাকা খরচ হবে তাও নির্ধারিত। তবে বরাদ্দ নিয়ে ঝামেলা আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীরা এই কল্যাণ তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের যোগান দেয় তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরা আনুপাতিক হারে বরাদ্দ পাইনা। তহবিলের কার্যক্রমে আরো স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

৩. প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড – এটিও আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। দুঃখের বিষয় এই যে, প্রবাসীদের কল্যাণের জন্যে হলেও এই বোর্ডে প্রবাসীদের কোন প্রতিনিধি নেই। আছেন রিক্রুটিং এজেন্টদের প্রতিনিধি ! প্রত্যাগত প্রবাসীদের থেকে কয়েকজনকে মনোনীত করার কথা, কিন্তু এখনো হয়নি! কি প্রক্রিয়ায় করা হবে তাও বলা হয়নি।

৪. অভিবাসী আইন ২০১৩ – এই আইনে NRB কথাটি নেই। যা আছে তা হলো “অভিবাসী” ও “অভিবাসী কর্মী “। আমরা যারা মধ্যপ্রাচ্যে আছি তারা সম্ভবত “অভিবাসী কর্মী” ক্যাটাগরীতেই পড়ি।

এই আইনে যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, এবং যারা অভিবাসী কিন্তু এখনো বাংলাদেশের নাগরিক তাদের পার্থক্য বোঝা দুরুহ। এই অস্বচ্ছতা প্রবাসী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে অর্থায়ন ও আয়করের ক্ষেত্রে। সরকারি আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের বেলাতেও এই অস্বচ্ছতা বৈষম্য তৈরী করছে। আবারও পার্শ্ববর্তী দেশের উদাহরণ দেয়া যায়। ভারত অভিবাসী যারা ভারতীয় নাগরিক তাদেরকে NRI ( Non Resident Indian) এবং যারা নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদেরকে PIO ( Person Of Indian Origin) হিসাবে অভিহিত করে। সুযোগ সুবিধাও সেভাবে নির্ধারিত। অভিবাসী আইন ২০১৩ প্রণয়নে প্রবাসীদের একটি ভূমিকা থাকা উচিত ছিল। আমাদের অংশগ্রহনে এই আইন যুগোপোযোগি করা হবে এই দাবি আমরা করতেই পারি।

৫. প্রবাসীদের ভোটাধিকার – এই ইস্যূটি সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অবহিত কিন্তু এখনো কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমাদের প্রায় এক কোটি নাগরিক প্রবাসী এবং ভোটার হওয়ার যোগ্য। তাই এই ভোটারদের ছাড়া নির্বাচন কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক।

আবার অনেকেই আছেন যারা তালিকাভুক্ত ভোটার কিন্তু প্রবাসী। এদের জন্যে RPO 1972 মোতাবেক পোষ্টাল ব্যালটের আইন আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সহজ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশই নিজের প্রবাসীদের জন্য খুব পরিপাটি করে নিজ দূতাবাসের মাধ্যমে পোষ্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করেছে, আমরা পারিনি। এমনকি এ নিয়ে কোন ধরণের চাপও সৃষ্টি করতে পারিনি। এই মৌলিক অধিকারটি যথাযথ ভাবে তুলে ধরা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

৬. সংসদে প্রবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন – আমরা প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির শক্ত একটি স্তম্ভ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি অতি নির্ভরযোগ্য উৎস। এবং এজন্যে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হয়নি। এই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে আমরা প্রবাসীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণও করিনি। অথচ দেশের নীতি নির্ধারণী কোন কমিটিতেই আমরা নেই। সংসদে সংরক্ষিত আসন নূতন কিছু নয়। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে আমাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে এবং এই সুবাদে আমরা সংসদে আমাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দাবি করতেই পারি।

৭. নিবন্ধিত সংগঠন – প্রবাসীদের স্বার্থ দেখার জন্য প্রবাসীদের নিজেদের কোন সংগঠন নেই যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত। তাই আমাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কিছু নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌঁছানো কষ্টকর। ব্যবসায়ীদের, পেশাজীবিদের, শ্রমিকদের সবারই নিজস্ব সংগঠন আছে। নিমিষেই উনাদের দাবি দাওয়া সরকারের কাছে পৌঁছে যায়, আর আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকি।

এই সুযোগে প্রবাসীদের নামে বেশ কয়েকটি নাম সর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠেছে, অনেকেই প্রশংসনীয় ভাবে দৃশ্যমান তবুও যেহেতু প্রবাসীরা তেমন ভাবে সম্পৃক্ত নয় তাই এ সংগঠনগুলো প্রবাসীদের ইস্যূগুলো যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারছে না এবং সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত একটি সংগঠন আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।

৮. পেনশন – এবারের এই করোনা অতিমারিতে প্রবাসীদের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশী নাগরিক প্রবাসীদের অসহায়ত্ব অত্যন্ত নির্মম ও নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। এয়ারলাইনসের পাইলট থেকে সাধারণ শ্রমিক অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, অনেক ব্যবসায়ী প্রভূত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অনেককেই দেশে ফিরে যেতে হয়েছে। কেউ কেউ একেবারে খালি হাতেই গিয়েছেন।লকডাউন ও বিমান ভ্রমনে বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞায় জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকের পক্ষেই এ ক্ষতি সামলে উঠা সম্ভব হয়নি। জীবিকা হারিয়ে অনেকেই সর্বশান্ত। অনেকেই দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে ফিরেছেন, দীর্ঘ সময়ধরে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশসেবা করেছেন, অথচ জীবনের এমন সংকটকালে কোন সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না। রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের জন্য একটি পেনশন স্কীম অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। রফতানিকারকরা নগদ প্রনোদনা ছাড়াও আরো অনেক ধরনের সুবিধা ও ভর্তুকি পান, সরকারি চাকরিজীবিরাও চাকরি শেষে পেনশন পান, আমরা প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে জাতীয় উন্নয়নে একটি প্রধান ভূমিকা রাখার সুবাদেও পেনশন দাবী করতে পারি।

৯. আহত/মৃত প্রবাসীর পক্ষে আইনী সহায়তা ও স্বাস্থ্য বীমা – কর্মস্থলে আহত অথবা অসুস্থ হয়ে অনেকে চাকুরী হারান, কেউ আহত হয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করেন, কেউ কেউ দুর্ঘটনায় নিহত হন , করোনার মতো দুর্যোগে চাকুরীচ্যূত হন, প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ অথবা গ্র্যাচুইটি নিয়ে ঝামেলায় পড়েন। অনেকে কিছু না করতে পেরে খালি হাতেই দেশে ফিরেন। আইনী সহায়তা ছাড়া এগুলো উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জেনেছি যে, এ খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের জন্য দূতাবাস বা কনসুলেটের পক্ষে সকল ভুক্তভোগীকে সহায়তা করা সম্ভব হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণ চিকিৎসা সেবা স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমেই দেয়া হয়। স্বাস্থ্য বীমাও ব্যয়বহুল। তাই সাধারণ প্রবাসী বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকরা নূন্যতম সেবার বীমা করে থাকেন, তাতে জরুরি সেবা ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে অনেকেই দেশে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন বলে রোগ নিয়েই অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে দেশেও চিকিৎসা সেবার অবাধ বানিজ্যিকীকরণে তা নাগালের বাইরে। দেশে একটি লাগসই স্বাস্থ্য বীমা এই অসহায় অবস্থা নিরসনে উপকারে আসবে বলেই বিশ্বাস।

এ দু’টির সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া একটি নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছি।

এর সব গুলোতেই সরকারের অংশগ্রহণ প্রয়োজন, তবে এটাও ঠিক সরকার একা সমাধান দিতে পারবেনা। আমরা যারা প্রবাসী কমিউনিটির জন্য কাজ করি আমাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। কাজটি মোটেও সহজ নয়, তবে অসম্ভব কিছু নয়। আমরা যেমন দলীয় কার্যক্রমে বেশ সক্রিয়, একটু চেষ্টা থাকলে প্রবাসীদের জন্যেও আমরা একটি ফলপ্রসু উদ্যোগ নিতে পারবো। আসুন আমরা সবাই মিলে শুরু করি।

লেখক: সমাজকর্মী এবং আন্তর্জাতিক একটি এয়ারলাইন্স-এ কর্মরত, দুবাই