আজ প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর শুভ জন্মদিন

মাহবুব জয়নুল মাহবুব জয়নুল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ, মে ২৫, ২০২১ 602 views
শেয়ার করুন

বিদ্রোহী কবি, জাতীয় কবি, প্রেমের কবি- কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬ তম জন্মদিন । সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ । একাধারে লিখেছেন কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস; ছিলেন সফল গীতিকার, সুরকার ও সংগীত শিল্পী ।

 

“যদি আর বাঁশি না বাজে… আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন…”

ভুলে যেতে বলাটাই কবিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। আমরা ভুলতে পারিনা সাম্যের গান । আমরা ভুলতে পারিনা বৈষম্য বিরোধী গান । আমরা ভুলতে পারিনা কি দারুণ সাহসে কবি বলে গেছেন —
“তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ !”

প্রাণের ভেতরের যে সত্য , যে ধর্ম, তার উপর কোন ধর্ম নেই, নজরুলই আমাদের শিখিয়ে যান । কবি তার প্রথম সন্তানের নাম রাখেন “কৃষ্ণমোহাম্মদ”–ধর্মের উপরে যে মানুষ সত্য, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবার আগে আমরা যে মানুষ , তার অসাধারণ উদাহরণ এভাবেই কবি নজরুল (মে ২৫, ১৮৯৯ — আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) রেখে যান । আর তাই আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কবি বেঁচে থাকেন ভালোবাসার উষ্ণতায়, আপন উজ্জ্বলতায়, । যে উজ্জ্বলতার জন্য কবির সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,-

“আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দূর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষণের এই তিলকরেখা , রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন !”
Nazrul2
কবির জীবন :

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে । তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। ছোট বেলায় নজরুলের ডাকনাম ‘দুখু মিয়া’ ।

১৯০৮ সালে নয় বছর বয়সে তার বাবা মারা যায় । পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে দশ বছর বয়সে তাকে কাজ করতে হয়। এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন । একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন।

বাল্য বয়সেই একটি লেটো (কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। তখন থেকেই তাকে সবাই কবি নজরুল বলে ডাকত।

১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন।

যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়।

১৯২০ সালের জুলাই মাসে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।

১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল।

১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ পড়েন এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকেন ।

১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’-তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় ।

সাহিত্য:
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন অত্যন্ত সমৃদ্ধ । গল্প, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস সবকিছু মিলিয়ে তার রচনা সংখ্যা অনেক ।
কবিতা:
অগ্নিবীণা (কবিতা) ১৯২২, সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন) ১৯২৫, ফনীমনসা (কবিতা) ১৯২৭, চক্রবাক (কবিতা) ১৯২৯, সাতভাই চম্পা (কবিতা) ১৯৩৩, নির্ঝর (কবিতা) ১৯৩৯, নতুন চাঁদ (কবিতা) ১৯৩৯, মরুভাস্কর (কবিতা) ১৯৫১, সঞ্চয়ন (কবিতা সংকলন) ১৯৫৫, নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা (কবিতা সংকলন) ১৯৮২ ।

কবিতা ও সংগীত:
দোলন-চাঁপা (১৯২৩), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙ্গার গান ( ১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), চিত্তনামা (১৯২৫), সাম্যবাদী (১৯২৬), পুবের হাওয়া (১৯২৬), সর্বহারা (১৯২৬), সিন্ধু হিন্দোল (১৯২৭) , জিঞ্জীর (১৯২৮), প্রলয় শিখা (১৯৩০) , শেষ সওগাত (১৯৫৮) ।

সংগীত:
বুলবুল (গান) ১৯২৮, সন্ধ্যা (গান) ১৯২৯, চোখের চাতক (গান) ১৯২৯, নজরুল গীতিকা (গান সংগ্রহ) ১৯৩০, নজরুল স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৩১, চন্দ্রবিন্দু (গান) ১৯৩১, সুরসাকী (গান) ১৯৩২, বনগীতি (গান) ১৯৩১, জুলফিকার (গান) ১৯৩১, গুল বাগিচা (গান) ১৯৩৩, গীতি শতদল (গান) ১৯৩৪, সুর মুকুর (স্বরলিপি) ১৯৩৪, গানের মালা (গান) ১৯৩৪, স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৪৯, বুলবুল দ্বিতীয় ভাগ (গান) ১৯৫২, রাঙ্গা জবা (শ্যামা সংগীত) ১৯৬৬ ।

ছোট গল্প:
ব্যাথার দান (ছোট গল্প) ১৯২২, রিক্তের বেদন (ছোট গল্প) ১৯২৫, শিউলি মালা (গল্প) ১৯৩১ ।

উপন্যাস :
বাঁধন হারা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০), কুহেলিকা (১৯৩১) ।

নাটক:
ঝিলিমিলি (নাটক) ১৯৩০, আলেয়া (গীতিনাট্য) ১৯৩১, পুতুলের বিয়ে (কিশোর নাটক) ১৯৩৩, মধুমালা (গীতিনাট্য) ১৯৬০, ঝড় (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬০, পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬৪ ।

প্রবন্ধ:
যুগবানী (১৯২৬), ঝিঙ্গে ফুল (১৯২৬), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), রুদ্র মঙ্গল (১৯২৭), ধুমকেতু (১৯৬১) ।

 

আমার কৈফিয়ত

কাজী নজরুল ইসলাম

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!

কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!

গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’

আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী,
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী!

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?

বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাত জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!

আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।

বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে!

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!