হজ্জ্ব স্মৃতি: পূণ্যময় দিনগুলো

মো. তারিকুল ইসলাম মো. তারিকুল ইসলাম

উপাধ্যক্ষ, বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ

প্রকাশিত: ২:৪২ অপরাহ্ণ, মে ৬, ২০২০ 694 views
শেয়ার করুন

হজ্জ্বব্রত পালনের ইচ্ছা আমার ছিল অনেক দিন থেকেই ।কিন্তু টাকা পাব কোথা থেকে । আমার স্ত্রী এগিয়ে আসল । সংসার খরচের জন্য ওর হাতে যে টাকাটা দিতাম তা থেকে ও কিছু টাকা গত দশ বছরে জমিয়েছিল । হিসেব করে করে দেখলাম ওর জমানো টাকার সাথে আর কিছু টাকা আমার ভবিষৎ তহবিল থেকে যোগ করলে কাজটা হয়ে যাবে । হলোও তাই । ৩০ আগস্ট২০১৬ রাত ৯:৪৫এ সউদী আরবের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী হয়ে । এটিই আমার একাধারে প্রথম বিমান ভ্রমণ এবং বিদেশ ভ্রমণ ।তাই সবকিছুতেই কিছুটা আড়ষ্ঠতা ছিল বলতে দ্বিধা নেই ।আমি ডায়াবেটিক রোগী । তার উপর ইনসুলিন নিতে হয় ।বিমানে অবস্থানকালীন সময়ে ইনসুলিন সংরক্ষণ করব কিভাবে সে চিন্তা মাথায় বারাবর আসছিল।সউদী আরবে ঔষধের দাম নাকি অনেক । তাই আমার ডাক্তার আমাকে প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে নিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ।একটি ছোট প্লাস্টিকের কৌটার বরফগলা পানিতে চারটি ইনসুলিনের এ্যাম্পুল নিয়েছিলাম । এসি থাকা সত্ত্বেও কৌটায় পানির তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছিল । চিন্তিত হলাম কিছুটা । কতর্ব্যরত বিমানবালার সাহায্য নিলাম । তিনি আমার ইনসুলিন বিমানের হিমযন্ত্রে রাখলেন এবংআমার বিমানে অবস্থানকালীন সময়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করলেন।আমাদের হালকা নাস্তার সাথে যে কোমল পানীয় দেয়া হয়েছিল আমি তা একপাশে সরিয়ে রাখছি দেখে বিমানবালা বললেন-স্যার , ওটা ডায়েট কোমল পানীয় ।খেলে আপনার ক্ষতি হবে না ।

বুঝলাম সবদিকেই খেয়াল রাখেন এই সেবাপরায়না নারী । বিমান যখন জেদ্দার মাটি স্পর্শ করল তখন তাড়াহুড়ো করে ইনসুলিনের কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম ।কিন্তু বিমানবালা স্বপ্রনোদিত হয়ে ইনসুলিনের কৌটা আমাকে এনে দিলেন যেমনটা বাবা কিংবা ভাই ঘর থেকে বের হলে মেয়ে কিংবা বোন এটা সেটা এগিয়ে দেয় ।

মক্কায় মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগে যায় ।আবহাওয়া, খাবার দাবার সবকিছুই ভিন্ন ধরণের । বাইরে প্রচন্ড গরম আর ঘরের ভিতর এসির অত্যাচার । একমাত্র শান্তির জায়গা হচ্ছে হরম শরীফ ।তবে সেখানে তো সারাবেলা থাকা যায় না।খাওয়া, গোসল,ঘুমানো এবং বিশ্রামের জন্য হোটেলে ফিরতে হয় ।এভাবে কেটে যাচ্ছিল আমাদের মক্কার দিনগুলো । আমার পাশের রুমে ছিলেন হাজী তোফায়েল ভাই । মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে সব মিলিয়ে তাঁর প্রবাস জীবনের মেয়াদ দুই যুগেরও বেশী ।আরবি জানেন কাজ চালানোর মত ।আর উর্দুতে রীতিমত বক্তৃতা দিতে পারেন । শারজাহতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যখন পাকিস্তানিরা ছোট করে দেখার চেষ্ঠা করছিল তখন তোফায়েল ভাই বলেছিলেন-তোদের ইজার খোলে দেখ ৭১ এর মারের দাগ তোদের পাচায় এখনও আছে । গোটা হজ্জ্ব মৌসুমে তোফায়েল ভাই ছিলেন আমাদের গাইড তাঁর বহুমুখী অভিজ্ঞতার জন্য । আমাদের ট্রাভেল এজেন্টের সরবরাহ করা খাবারে যখন অরুচি হওয়া শুরু হল , তখন তোফায়েল নিজেই রান্না করা শুরু করে দিলেন । একদিন তোফায়েল ভাই রান্না করছিলেন ।পাশে আরএক বাঙালী মহিলা হাজীও রান্না করছিলেন ।পুরুষের রান্না যত ভাল হোক না কেন মহিলাদের চোখে তা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য । তাই ঐ মহিলা তোফায়েল ভাইকে দেখিয়ে দিলেন রান্নাটা কিভাবে সুস্বাদু করা যায় । মহিলা ডিম ভাজছিলেন । আমাদের আসার সময় অনেকটা জোর করেই তাঁর ভাজা ডিমের বেশ কিছুটা অংশ আমাদের দিলেন ।

এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল । দেখতে হজ্জ্বের মূল আনুষ্ঠানিক পর্ব এসে গেল। মিনা ,আরাফাত ,মুযদালিফা এবং জামারা পর্ব শুরু হল ।আরাফাত ময়দান থেকে মুযদালিফা যাওয়ার সময় ট্রাভেল এজেন্টের অদক্ষতার কারণে বাস পেতে দেরী হচ্ছিল । ধৈয্যর্চ্যুতি ঘটাতে আমি, আমার মেঝভাই সিরাজুল ইসলাম , তোফায়েল ভাই এবং সহযাত্রী তিন হাজী সাহেবসহ কিছু পথ হেটে আর বাকিটা পথ ভাড়া করা গাড়িতে রাত দশটা নাগাদ মুযদালিফায় পৌছলাম । জামারার প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করে উন্মুক্ত প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের উপরে বিছানা পাতলাম ।অভিজ্ঞতার অভাবে সাথে সাথে তেমন কোন খাবার আনিনি । সবাই ক্ষুধার্ত । কি করা যায় বুঝে উঠতে পারছিলাম না ।আমি আর তোফায়েল ভাই খাবার খোজতে গিয়ে শূন্যহাতে ফিরে এলাম ।ছয়জন মানুষের খাবার হিসেবে এক কনটেইনার ছিড়া এবং সামান্য কয়েকটি খেজুর যথেষ্ট ছিল না । যা হোক তাই ভাগ করে খাওয়া শুরু করলাম ।

মনে মনে অধর্ভুক্ত থাকার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম আমরা সবাই । হঠাৎ অনতি দূরে বিছানা পেতে স্বামী সন্তানসহ আশ্রয় নেয়া এক মহিলা বেশ কয়েকটা দুধের বোতল এবং আপেল নিয়ে আসলেন ।আমরা পরস্পরের ভাষা জানিনা । কিন্তু আমাদের যে খাবারের প্রয়োজন তা এ নারী বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই । যাক পাথরের উপরে পাতানো বিছানায় ঘুমাতে পারব কিনা সন্দেহ ছিল কিন্তু পরক্ষণে বুঝলাম আমরা ভীষন ক্লান্ত। পাথুরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ামাত্রই প্রায় সবাই একসাথে ঘুমিয়ে পড়লাম ।ঘুম ভাংগল ফজরের নামাজের আযানের শব্দে ।নামাজ শেষে প্রথম প্রহরে জামারায় পাথর নিক্ষেপ করতে পারলাম নিবির্ঘ্নে ।হজ্জ্বের এ পর্বে সবাই কিছুটা ভীত ছিলাম কারণ গত বছর এখানেই পাথর নিক্ষেপ করতে গিয়ে বাংলাদেশীসহ অনেক হাজীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল । আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা হজ্জ্বের প্রতিটি পর্বই ভালভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম ।
হজ্জ্ব পরবর্তী সময়ে দুটো ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কাটে । মদিনা যাওয়ার পূর্বে আমাদেরকে আয়েশা মসজিদে যেতে হয় ওমরার নিয়ত ও ইহরাম বাধার জন্য । হরম শরীফের কাছের একটি বাস স্টপ থেকে ওখানে যেতে হয় । বাসে বেশ ভীড় হয় । সীট পেতে হাজীদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা লেগে যায় ।

ওমরা পালনের জন্য এক বিকেলে আয়েশা মসজিদে যাওযার সময় এক পাকিস্তানি মহিলা বাসে উঠতে পারলে ও তার বৃদ্ধ স্মামী বাসে উঠতে পারেননি ।আর তাতেই শুরু হয় করুণ আহাজারি । মহিলা তার স্মামীকে ছেড়ে কিছুতেই আয়েশা মসজিদে যাবেন না, আবার ভীড়ের কারণে বাস থেকে তার পক্ষে নামা সম্ভবও হচ্ছে না ।সংকট নিরসনে তোফায়েল ভাই আবারও এগিয়ে এলেন । তিনি মহিলাকে বুঝালেন দুশ্চিন্তার তেমন কিছু ঘটেনি ।মিনিট দশেক পরের বাসে করে তার স্মামী আয়েশা মসজিদে পৌছতে পারবেন। বেশী দেরী হলে মসজিদে গিয়ে আমরা তার স্মামীর আসা পযর্ন্ত অপেক্ষা করব । এবার বৃদ্ধার মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল । তিনি হাত তুলে তোফায়েল ভাইয়ের জন্য দোয়া করলেন চোখে মুখে এক অনিবর্চনীয় কৃতজ্ঞার ভাব ফুটিয়ে । যাক আয়েশা মসজিদে আমাদের বাস এবং পরবর্তী বাস প্রায় একই সময়ে পৌছল বৃদ্ধার উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে ।

হজ্জ্ব পরবতরর্তী সময়ে একবার আসরের নামাজ শেষে হোটেলে ফিরছিলাম ।প্রচন্ড গরমের কারণে প্রায় সব হাজীরাই ছাতা ব্যবহার করছিলেন। হঠাৎ চট্টগ্রামের পটিয়া অঞ্চলের এক বয়স্ক দম্পতির দিকে দৃষ্টি গেল ।পাশাপাশি হাটছিলাম ।ওঁদের কতাবার্তা থেকে বুঝলাম মহিলার নাম ফরিদা । একহাতে একটি ব্যাগ আর অন্যহাতে ছাতা মেলে রোদ থেকে স্বামীকে রক্ষা করছিলেন ।নীজে রোদে ঘামছেন কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই এবং নীজকে রোদ থেকে বাচানোর ইচ্ছা নেই বলে মনে হল । তারঁ স্বামী যে শারিরীকভাবে খুব দূর্বল এমনটা মনে হল না ।মনে রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না । বৃদ্ধকে বললাম ,আপনি ছাতা কিংবা ব্যাগের অন্তত একটা হাতে নিন , না পারলে ব্যাগটা আমার হাতে দিন । আমি হোটেল পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসব । বৃদ্ধ তার ভুল বুঝতে পারলেন

। স্ত্রীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে এমনভাবে হাটতে লাগলেন যাতে ছাতার ছায়া দুজনের উপর সমানভাবে পড়ে । নারীর ত্যাগের এমনি অনেক ঘটনা গোটা হজ্জ্ব মওসুমে আমার নজরে পড়েছে । দেখতে দেখতে সৌদী আরবে আমাদের অবস্থানের সময় শেষ হয়ে আসল।শেষ পর্বে আমরা বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ(সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত মদিনা গেলাম । মসজিদ এ নবুবীতে নামাজ , জিয়ারত এবং অন্যান্য ইবাদত করে মদিনায় ৭।৮ বেশ দ্রুত কেটে গেল ।১৩ অক্টোবর দুপুর ১২টায় মদিনা থেকে জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম । স্থানীয় সময় রাত ৩:৩০ টায় বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী হয়ে সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা করলাম ।

বাড়ি ফিরছি , দীর্ঘ দেড়মাস পর স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের সাথে দেখা হবে -এ আনন্দের ঘুর্ণাবর্তে মন আলোড়িত ।আমার আসনের সামনে রক্ষিত মনিটরে ভেসে উঠছিল বিমানের গমনপথের যাবতীয় ত্রিমাত্রিক চিত্র ও তথ্যাবলী ।ক্রমশ সিলেটের দুরত্ব কমছিল ।মনে আনন্দ জোয়ার প্রবলতর হচ্ছিল । আল্লাহর রহমতে অবশেষে স্থানীয় সময় দুপুর ১২:৩০ টায় আমাদের বিমানটি সিলেট বিমান বন্দরের মাটি নিরাপদে স্পর্শ করল ।

ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দেখলাম আমার স্ত্রী পুত্র দাড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষায় ।পুত্রকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ জানালাম হজ্জ্ব শেষে আমাকে নিরাপদে স্ত্রী , পুত্র ও কন্যাদের মাঝে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য।