একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত ফারহান। লাভলী’র সঙ্গে দুই বছরের প্রেম। পারিবারিক ভাবে মেনে নেয় তাদের দুই পরিবার। এরপর ঠিক হয় বিয়ের দিন তারিখ। শেষ হয় বিয়ের কেনাকাটা। এপ্রিল মাসে তাদের বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু বাদ সাধে করোনা।
আটকে আছে এ বিয়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা বসবেন বিয়ের পিঁড়িতে। করোনার ভয়াল আতঙ্কে আটকে আছে এমন অনেক বিয়ে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গত চার মাসে বিয়ে হয়েছে অনেক কম। যেসব বিয়ে হচ্ছে তাতেও নেই আনন্দ। আগের মতো ধুমধাম করে, সানাই বাজিয়ে বিয়ে আর হচ্ছে না। একেবারেই সাদামাটা, বর ও কনেপক্ষের ক’জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। তাও আবার কনের বাড়ী কিংবা তাদের স্বজনদের বাড়িতে। আর দৌড়াতে হচ্ছে না কমিউনিটি সেন্টারে, ডেকোরেটর ভাড়াও নিতে হচ্ছে না। ইচ্ছা থাকলেও সেখানে বাধা হলো করোনা।
এমনই একজন সদ্য মাস্টার্স শেষ করা জুহি। পরিবারের সঙ্গে থাকেন নগরীর খুলশিতে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্জিনিয়ার পাত্র আরমানের সঙ্গে তার আকদ সম্পন্ন হয়। এপ্রিলের শেষের সপ্তাহে বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। জুহির ভগ্নিপতি জানান, হঠাৎ করে করোনার থাবা। সব এলোমেলো করে দেয়।
ছেলে মেয়ে বড় হলে মা-বাবা তাদের বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আবার বিয়ের জন্য ছেলে-মেয়ে দেখারও প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু করোনার এই সংকট মুহূর্তে থমকে গেছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। অনেকে সাদামাটাভাবে সেরে নিচ্ছেন বিয়ের কাজ। এদিকে,পটিয়ায় করোনার কারণে থমকে গেছে বিয়ের সঙ্গে জড়িত পার্লার, কাজী অফিস, ম্যারেজ মিডিয়া, ক্যাটারিং সার্ভিস, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, জুয়েলারি ও বিয়ের সাজ-সজ্জার দোকানের বেচা-বিক্রিও।
পটিয়া ম্যারেজ মিডিয়া সেন্টারের মালিক ফেরদৌস জানান, ২১ বছর ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। করোনার কারণে যেখানে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ সেখানে আমাদের ব্যবসা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মূলত অনলাইনে কাজ করি। আগেও অনলাইনেই কাজ করেছি। আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাত্র-পাত্রীর বায়োডাটা, ছবি দেখাতাম। ব্যাগে করে নিয়ে যেতাম। আমাদের অফিসে লোকজন এসে দেখতো। কিন্তু এখন প্রযুক্তি উন্নত হওয়ায় আমাদের ব্যবসার ধরন বদলেছে। এখন আমরা আর হার্ড কপি কাউকে দেখাই না। অনেক আগে থেকেই দেখাই না। ই-মেইল করি। তাদের ই-মেইল আমরা চেক করি। এর মাঝে আর কোনো পক্ষ থাকে না। তবে করোনার প্রভাব যে একেবারে পড়েনি তা নয়। করোনার কারণে ছেলে-মেয়েদের দেখা-সাক্ষাৎ করাতে পারি না। আগে ছেলে-মেয়ের বাড়ি থেকে যে আমন্ত্রণ করা হতো সেটা এখন আর কেউ করেন না। রেস্টুরেন্টেও সম্ভব হচ্ছে না। একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত আমরা যেতে পারছি অনলাইনে। দেখা-সাক্ষাৎ এবং বিয়ে-সাদির বিষয়টি ছাড়া বাকি সব কাজই এখানে হচ্ছে। করোনা শেষে হয়তো সাকসেক স্টোরিটা শুরু হয়ে যাবে। আগে ছেলে এবং মেয়ে দুই পক্ষ থেকে বিয়ে শেষে একটা টাকা সম্মানী পেতাম। সেই টাকা এখন আমরা পাচ্ছি না গত তিন মাস ধরে।
পটিয়ার বধুয়া বিউটি পার্লারের বিউটিশিয়ান রুমানা বলেন, তিন মাসের ও বেশি সময় ধরে আমাদের পার্লার বন্ধ। একেবারেই খোলা হচ্ছে না। কবে খোলা হবে সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। অনেক কর্মীকেই বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা যারা আছি তাদের শতকরা ৫০ ভাগ বেতন দেয়া হচ্ছে।
পেশায় কাজী মোজাম্মেল হক জানান, এই পেশার সঙ্গে যুক্ত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। করোনার প্রায় ৯০ ভাগ প্রভাব পড়েছে আমাদের এই পেশায় । আগে দেখা গেছে প্রতি শুক্রবারই যেখানে ৮ থেকে ১০টি বিয়ে হতো। এখন কোনো দিন একটি অনুষ্ঠানও হয় না। যেখানে আগে পুরো মাসে কম হলেও ২০ থেকে ৩০টি বিয়ের অনুষ্ঠান হতো। ১৫ বছরের পেশাগত জীবনে এ রকম সমস্যার মুখোমুখি কখনো হইনি। আগে যাদের বিয়ের কথা বা দিনক্ষণ ঠিক ছিল এমন দু’-একটি বিয়ে হয়েছে। তবে সেটাও সামাজিক দূরত্ব মেনে, মুখে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস পরে ৪ থেকে ৫ জনের উপস্থিতিতে। পটিয়া থানার মোড়ের রাণি জুয়েলার্সের কর্মচারী বান্টু বাবু বলেন, করোনায় মানুষের জীবন বাঁচে না। সেখানে অলঙ্কার ক্রয়তো অনেক পরের কথা। দীর্ঘ লকডাউনের পর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দোকান খোলা থাকলেও কোনো ক্রেতা নেই। দু’একজন এলেও তারা দেখে চলে যান। আগে বিয়ের অলঙ্কার, হাতের বালা, ছোট বাচ্চাদের হাতের চুরি, চেইন ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতিদিন কম হলেও কয়েক লাখ টাকা বিকিকিনি হতো সেখানে এখন সারা মাসেও এক লাখ টাকার সেল নেই।
পটিয়ার সবুর রোডের আলম প্লাজার স্বর্ণা শপিং কর্নারের কর্মচারী সুজন বলেন, আমাদের দোকানে গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে বর-কনের, শাড়ী সহ বিয়ের যাবতীয় সাজ-সজ্জার কাপড় বিক্রয় হয়। তবে বিক্রি কমে গেছে শূন্যের কোঠায়। করোনার আগে কনের গর্জিয়াস শাড়ি ও হলুদের উপকরণ বেশি বিক্রয় হতো। গত এক মাসে সম্পূর্ণ একটি ব্রাইডাল সেট বিক্রি করতে পারি না। এভাবে কতোদিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবো জানি না।
গুলশান মেহেরিন চাইনিজ রেস্টুরেন্টের কর্মচারী কামাল বলেন, করোনার আগে রেস্টুরেন্টে বর-কনে দেখা, দুই পরিবারের অংশগ্রহণে ছোট-বড় পার্টির বুকিংতো ছিল নিয়মিত। প্রতিদিন কম হলেও ৫ থেকে ৭টি পার্টির অর্ডার পেতাম। করোনার কারণে আমাদের এখন প্রায় ৯০ ভাগ ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে। পার্টি সেন্টারে বসে এখন খাওয়ার কোনো সিস্টেম নেই। সম্পূর্ণ ক্লোজ। কোনো পার্টি হচ্ছে না। আমরা নামে মাত্র খুলে রেখেছি। শুধু কিছু পার্সেল যদি বিক্রি হয় সেই আশায়। করোনার আগে যেখানে প্রতিদিন এক লাখ থেকে ৬০ হাজার টাকার সেল হতো দৈনিক, এখন সেটা ৫ হাজার টাকাও হয় না। আগে যেখানে ২০ জন স্টাফ ছিল এখন সেখানে পাঁচজন দিয়ে চালাচ্ছি।
পটিয়া হল টু ডে কমিউনিটি সেন্টারের ম্যানেজার হোসেন বলেন, মার্চ মাসের ১৯ তারিখ থেকে আমাদের কমিউনিটি সেন্টারে সকল প্রকার অনুষ্ঠান বন্ধ। সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। করোনার কারণে আমরা আর্থিকভাবে বেশ লোকসানের শিকার হয়েছি। গড়ে প্রায় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে ।
