সাভারে রাতের আঁধারে গোলাপ বাগান কেটে নাশ, চাষীদের হাহাকার!

হুমায়ূন কবির হুমায়ূন কবির

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৬:১১ অপরাহ্ণ, মে ২, ২০২০ 505 views
শেয়ার করুন
ফুল পবিত্রতার প্রতিক। ফুল দিয়ে শুরু হয় যেকোনো শুভকাজ কিংবা সম্পর্কের বন্ধন। ফুলকে ভালোবাসার প্রতীকও ধরা হয়। দুঃখজনক ভাবে রাতের আঁধারে কেটে ধ্বংস করা হয়েছে ৯ বিঘা ফুলের বাগান। সরকারি জমিতে ১৫ বছর ধরে গোলাপের চাষ করে আসছিলেন ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের কৃষক নাজিম উদ্দিন। রাতের আধারে দুর্বৃত্তরা তাঁর গোলাপ বাগান কেটে ধ্বংস করেছে। কেড়ে নিয়েছে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বেচারা নাজিমউদ্দিন এখন বিচারের আশায় ধরনা দিচ্ছেন সমাজের উঁচু থেকে নিচু পর্যায়ের সবার কাছে। উপযুক্ত বিচার পাওয়ার আশায় দ্বারস্থ হয়েছেন প্রশাসনেরও। সাভার থানায় করেছেন অভিযোগ। শুধু নাজিম উদ্দিন নন, ওই এলাকার আরও কয়েকজন কৃষকের প্রায় ৯ বিঘা জমির গোলাপের বাগান কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। সব জমিই সরকারি হলেও ইজারা নিয়ে তা দখলে রেখে ফুলের চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করত এলাকার নিম্নবিত্ত এসব কৃষক।
 
জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে হতবিহ্বল এসব কৃষক জানান, কোভিত-১৯’এর প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে‌ ক্রেতার অভাবে ফুল বিক্রি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিলো । লকডাউন কিংবা হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে গিয়ে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের কারণে এখন আর এলাকায় ফুলের হাটও বসে না। এলাকায় এখন অর্থাভাবে খাদ্য সংকটে ভুগছেন শতাধিক ফুল চাষী। এখানকার চাষীদের শতভাগ খাদ্যের যোগান আসতো ফুল বিক্রি করা অর্থ থেকে। প্রত্যাশা ছিল করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফুল বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে অবসান হবে তাদের খাদ্য সংকটের এবং ফিরে পাবেন স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন। দুঃখজনকভাবে দুর্বৃত্তরা তাদের সেই স্বপ্নও করেছেন ভেঙে চুরমার। হতদরিদ্র এসব চাষী পরিবারে একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে চলছে মাতম।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলেন স্থানীয় বিরুলিয়া ইউনিয়নের (ইউপি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল আলিম বলেন, ইউনিয়নের কুমার খোদা মৌজাসহ আশপাশের এলাকায় কয়েক হাজার একর সরকারি জমি রয়েছে। এসব জমি বন বিভাগের বলেই জানেন স্থানীয় লোকজন। এলাকার কৃষকেরা পতিত এসব জমি প্রায় ৭০ বছর ধরে দখলে রেখে চাষাবাদ করে আসছেন। কয়েক বছর ধরে অন্য এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ইজারা নিয়ে এসব জমি দখল শুরু করছেন। তাঁরা প্লট আকারে এসব জমির দখল টাকার বিনিময়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন অন্যদের। যাঁরা টাকা দিয়ে প্লটের দখল নিচ্ছেন, তাঁরা পাকা, আধা পাকা ও বহুতল ভবন নির্মাণ করে বসবাস করছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। ইউপি সদস্য যোগ করেন, জমি দখলে প্রভাবশালীদের সহায়তা করে থাকেন স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। তাঁরা ঈদগাহ ও কবরস্থানের নামে কয়েক বিঘা জমি দখলের পাঁয়তারা করছিলেন। সম্ভবত তাঁরাই রাতে গোলাপ বাগান কেটে ফেলেছেন।
 
কৃষকরা অভিযোগ করেন-হাসেম,জাহাঙ্গীর আল চিনু,হানিফ,বারেক,মুজিবুর, শহিদ, আমানউল্লাহর নেতৃত্বে বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারী তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বৃক্ষনিধনের মত এমন জঘন্য কাজটি সম্পাদন করে কৃষকদের পেটে লাথি মেরেছে। এ বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগ করেও তাদের পাওয়া যায়নি। 
 
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের একজন প্রায় ৭০ বছর বয়সী আনসার আলী। এই বৃদ্ধ বলেন, তিনি ৫০ বছর ধরে দুই বিঘা জমিতে চাষাবাদ করছেন। এর আগে তাঁর বাবা ওই জমি চাষ করেছেন। কয়েক বছর আগে ছয় লাখ টাকা ব্যয় করে তিনি জমিতে গোলাপের বাগান করেন। মাসে তাঁর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হতো। সার কীটনাশকসহ বিভিন্ন খরচাদি মিটিয়েও তিনি মোটামুটি ভাবে সংসার চালাতেন। কিন্তু গোলাপের বাগান কেটে ফেলার মধ্য দিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেলো পরিবারটি এবং বাধাগ্রস্ত হলো দুবেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার বিষয়টিও।
 
অপর কৃষক জালাল উদ্দিন জানান, কিস্তির টাকা দিয়ে বাগান করেন। বাগান কেটে ফেলায় কিস্তির টাকা তিনি কিভাবে শোধ দিবেন সে চিন্তায় এখন তার ঘুম হারাম। এই কৃষকের অভিযোগ তাঁরা যুগের পর যুগ ধরে সরকারি জমি চাষ করে খেয়ে পরে বেঁচে রয়েছেন। সরকার ইজারা দিতে চাইলে, তাঁর মতো গরিব কৃষকদের দিতে পারতো । আর সরকারের জমি প্রয়োজন হলে কৃষকেরা তা ছেড়ে দিতেন। কিন্তু জমি ইজারা দেওয়া হচ্ছে প্রভাশালীদের। এর ফলে কৃষকেরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিরুলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই অপূর্ব দত্ত বলেন, একটি পক্ষ কৃষকদের দখলে থাকা জমি ইজারা নিয়ে তা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। আরেকটি পক্ষ ওই জমিতে কবরস্থান ও ঈদগাহের মাঠ বানানোর চেষ্টা করছিল। সম্ভবত এই দুই পক্ষের কোনো এক পক্ষ গোলাপ বাগান কেটে ফেলেছে। মোবাইল ফোনে মৌখিক ভাবে খবর পেয়ে আমরা সাথে সাথেই কেটে ফেলা বাগান পরিদর্শন এসেছি। কৃষকদের বলেছি লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে অপরাধী যেই হোক তাকে কোন ছাড় দেওয়া হবে না। আইনের যথাযথ ধারা অনুসরণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে । বৃক্ষ নিধন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে ঘৃণিত ও একটি বড় ধরনের অপরাধ বলেও যোগ করেন তিনি।
 
অন্যদিকে সরকারি জমি হলেও রাতের আঁধারে ফসল কাটার অধিকার অন্য কারো নেই মন্তব্য করে সাভার মডেল থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, ভুক্তভোগী কৃষকদের পক্ষ থেকে সাভার থানায় অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
 
উল্লেখ্য বিরুলিয়া ইউনিয়নের বাগ্নীবাড়ি এলাকায় ২০১৯ সালের রবিবার (১৮ আগস্ট) রাতের আঁধারে ৪৫ শতাংশ জমিতে ইজারা নিয়ে লাগানো এক কৃষকের গোলাপ ও সবজির বাগানও কেটে ফেলেছিলো দুর্বৃত্তরা। সেই ঘটনার যথাযথ বিচার নিশ্চিত হলে পুনরায় এমনটি ঘটতোনা বলে মন্তব্য করছেন ভুক্তভোগীরা।
 
প্রতিবছর এসব বাগানের কয়েক লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হয়। খরচ বাদেও এসব ফুল বিক্রির মধ্য দিয়ে কোনমতে চলে যায় ফুল চাষীদের সংসার।কেটে ফেলা বাগানটি নতুন করে করতে গেলে প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে অর্থের। এছাড়া বাগানটি বর্তমান অবস্থায় আসতে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে । বাগান কেটে ফেলার কারণে জীবিকার প্রয়োজনে পথে বসা ছাড়া আর কোনো গতি নেই বলে মন্তব্য করেছেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা। দুর্বৃত্তদের উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।