শান্তিগঞ্জে পল্লী বিদ্যুতে চরম ভোগান্তি, জনমনে ক্ষোভ

বিদ্যুত বিতরণে বৈষম্যের অভিযোগ, পাগলায় বিক্ষোভে রাস্তা অবরোধ 

প্রকাশিত: ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৪, ২০২৩ 317 views
শেয়ার করুন
◾ বিদ্যুত বিতরণে বৈষম্যের অভিযোগ 
◾ পাগলায় বিক্ষোভে রাস্তা অবরোধ
পল্লী বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে চরমভাবে অসন্তুষ্ট শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন অসহনীয় পর্যায়ের ‘লোডশেডিং’ বিষিয়ে তুলেছে উপজেলায় বসবাস করা সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। একদিকে বিদ্যুতের চরম ভোগান্তি অন্য দিকে প্রচণ্ড তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে জনজীবন। গরমের বিষয়টি যা-ই হোক কেনো যদি নিয়মিত বিদ্যুত থাকে তাহলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলে জনসাধারণের মনে। বিদ্যুতের এমন ভোগান্তিতে ক্রমশ ফুঁসে উঠছেন শান্তিগঞ্জ  উপজেলাবাসী। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৮টায় পাগলা বাজার বাসস্ট্যান্ডে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে এফডিআর নামের একটি সামাজিক সংগঠন। তখন প্রায় আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরে সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এসময় শান্তিগঞ্জ উপজেলার একটি বিশেষ এলাকাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুত সরবরাহ করে অন্যান্য ইউনিয়নে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং করার অভিযোগ করেন বিক্ষোভকারীরা। এছাড়াও  প্রতি ইউনিয়নে বিদ্যুতের সমবণ্ঠন না করে বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে ধরেন তারা। অভিযোগ করে বলেন, বিশেষ একটি এলাকাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুত সরবরাহ করছে শান্তিগঞ্জ পল্লীবিদ্যুত।
উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত দেড়মাস ধরে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যুতের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। পূর্ব পাগলা, পশ্চিম পাগলা, দরগাপাশা, পূর্ব বীরগাঁও, পশ্চিম বীরগাঁও, পাথারিয়া ও শিমুলবাক ইউনিয়নব্যাপী বিদ্যুতের ভোগান্তি চরমে। সকাল থেকে দুপুর, বিকাল থেকে সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত এসব এলাকায়  বিদ্যুত থাকে না বললেই চলে। দিন কিংবা রাতের বেশিরভাগ সময়েই এসব এলাকায় বিদ্যুতহীন থাকতে হয় মানুষকে। বিদ্যুতের এমন পরিস্থিতি যে, একটি স্মার্টফোনকে শতভাগ চার্জ করা যায় না উপজেলার কোনো কোনো এলাকায়। এমনও রাত যায়, যে রাতে একটি বারের জন্যও দেখা মিলে না বিদ্যুতের। দিনের বেলা মাঝে মাঝে বিদ্যুতের দেখা মিললেও শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই আবার চলে যায়। বিদ্যুতের এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বেগ পোহাতে হচ্ছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী রোগীদের। লাগাতার বিদ্যুতহীনতায় স্কুল কিংবা বাসায় ব্যহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার। ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে মার খাচ্ছেন ব্যবসায়ও, বিশেষ করে বিদ্যুত সম্পর্কিত ব্যবসায় প্রতিদিনই লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
২৯ জুলাই শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত সময়ে বিদ্যুতের যাওয়া-আসার অস্বস্তিকর খেলাকে পরখ করেন এ প্রতিবেদক। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্যুত যাওয়ার পর ৭টা ৪৩ মিনিটে আসে। ৭টা ৪৩ মিনিটে আসা বিদ্যুত ৮টা ৩মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। ৮টা ৩ মিনিটে বিদ্যুত চলে যাওয়ার পর পাগলাবাজার এলাকা আরও ১৯মিনিটের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, বিদ্যুত আসে রাত ৮টা ২২ মিনিটে। এরপর মধ্যরাত অর্থাৎ ১২টা ২২ মিনিট পর্যন্ত স্বস্তি দেয় পল্লী বিদ্যুত। কিন্তু এ স্বস্তি পাগলা বাজার এলাকাবাসীর জন্য কালরাত্রির মতো হয়ে হাজির হয়। সেরাতে সারা রাত কোনো বিদ্যুতই পায়নি এ এলাকার মানুষ। বিদ্যুতে দেখা মিলে ৯ঘন্টা ১৮ মিনিট পর রবিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে। প্রচণ্ড গরমে মানুষের হা-হুতাশ দেখার মতো ছিলো না। এরপর কিছু সময় বিদ্যুত থাকার পর দুপুর ১২টা ৪৪মিনিটে আবার চলে যায়। যা ১২টা ৫৮ মিনিটের সংক্ষিপ্ত সময়ে আবারও আসে বিদ্যুৎ, কিন্তু ১টা ৫০ মিনিটে চলেও যায়। এর ১ঘন্টা ১৮মিনিট পর অর্থাৎ ৩টা ৮ মিনিটে বিদ্যুত আসে। দীর্ঘ ৪ঘন্টা ৮মিনিট বিদ্যুত থাকার পর সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিটে আরার বিদ্যুত চলে যায় এবং ৮টা ১৫ মিনিটে আসে। এর পরে রাত ঠিক ১২টায় আবারও বিদ্যুত চলে যায়। যা আসে রাত দেড়টায়। শেষ রাতের দিকে আবারো বিদ্যুত বিভ্রাট হলে যার দেখা মিলে সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায়। সোমবার ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যুত থাকে। এসময় লোডশেডিং হলে দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে বিদ্যুত আসে। এবারের বিদ্যুত আর বেশিক্ষণ টিকেনি। ১২টা ২৭মিনিটে চলে যায় এবং আসে ১টা ৩৮ মিনিটে। পরে আবার আড়াইটায় চলে যায়। বিকাল ৪টা ৩৭ মিনিটে আসলেও পরে আবার ৫টা ৩৮ মিনিটে চলে যায়। বিদ্যুতের যাওয়া আসার খেলা চলে সারা রাত। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত যা চলমান ছিলো। তিন দিনের পাগলাবাজার এলাকার এ সময়সূচি হিসেব করলে ২৪ ঘন্টায় গড়ে ১২ ঘন্টারও কম সময় বিদ্যুত পেয়েছে পাগলা এলাকার লোকজন। গত এক সপ্তাহের গড় হিসাবে পল্লী বিদ্যুত পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নে ১০/১২ ঘন্টাও বিদ্যুত দেয়নি। এ চিত্র শুধু পশ্চিম পাগলা এলাকার। এরচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য পূর্ব বীরগাওয়ের সলফ, নোয়াগাও, উমেদনগর, বীরগাঁও, খালপাড়, দরগাপাশার আক্তাপাড়া, সিচনী, বাংলাবাজার, আমরিয়া, ইসলামপুর, হরিনগর, ছয়হারা, পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চিকারকান্দি, পিঠাপশি, আলমপুর, পঞ্চগ্রাম, ঘোড়াডুম্বুর, ডিগারকান্দি, পশ্চিম পাগলার ব্রাহ্মণগাঁও, হোসেনপুর, নিদনপুর, ছোনানপুর, কাদিপুর, ইনাতনগর, পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম, শিমুলবাকের রঘুনাথপুর, উকারগাঁও, থলেরবন্দ, কুতুবপুরসহ প্রায় সমস্ত ইউনিয়ন, পাথারিয়ার বেশ কিছু গ্রামের পল্লী বিদ্যুতে বিদ্যুতহীনতার দৃশ্য এর চেয়েও ভয়াবহ।
ভুক্তভুগী মানুষরা বলছেন, উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি গ্রাম বা এলাকাকে তুলনামূলক বেশি বিদ্যুত সরবরাহ করছে উপজেলা পল্লী বিদ্যুত সমিতি। যা অন্যান্য গ্রাহকদের বিমাতা সূলভ আচরণের সমান। কিন্তু এমন অভিযোগ ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন শান্তিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতে সহকারি ব্যবস্থাপক (এজিএম)।
বিদ্যুতের এমন ভেল্কিবাজিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছোটন মিয়া, ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া উমামা আক্তার ও সৃজন দাশ বলেন, সারাদিন খুবই অবস্থা খারাপ। বিদ্যুত থাকেনা। স্কুলে গেলেও কারেন্ট পাইনা। সন্ধ্যায়-রাতেও বিদ্যুত পাই না। পড়াশোনার অবস্থা খুবই খারাপ।
পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের গাঙপাড় গ্রামের বাসিন্দা গীতিকবি এস.এম. রাবেদ। তিনি বলেন, বীরগাঁওয়ে বিদ্যুতের অবস্থা খুবই খারাপ। সারা দিন তো ডিসটার্ব করেই, রাতে একেবারেই থাকে না। বেশিরভাগ রাত ১১টার দিকে বিদ্যুত নিলে সারা রাতে আর আসেই না। সকালেও দেরি করে আসে। বিদ্যুত বিলতো ঠিকই আসে। বিদ্যুতের এমন বাজে অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবো? একই ইউনিয়নের কারি আয়ুব আলী বলেন, আমাদের সলফ গ্রামে বিদ্যুতে প্রচুর জ্বালাতন করে। খুবই কষ্ট হয় আমাদের।
চা বিক্রেতা মঈন উদ্দিন বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যা সময় সুনামগঞ্জ থেকে পাগলায় ফিরছিলাম, তখন দেখেছি জয়কলস, শান্তিগঞ্জ বাজার, উপজেলা পরিষদ ভবন, হাসপাতাল, কামরুপদলং, সদরপুর এমনকি আস্তমা গ্রামেও বিদ্যুত ছিলো। পাগলায় বিদ্যুত ছিলো না। তার কথার সাথে সুর মিলান পাগলার হোসেনপুর গ্রামের রিকশা চালক আতাউর রহমান। তিনি বলেন, পরশুদিন (মঙ্গলবার) সারাদিন ছিলাম ডুংরিয়া গ্রামে। একটাবারও কারেন্ট নেয়নি।
পাগলা বাজার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সদস্য নাসির মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার প্রতি বিমাতা সূলভ আচরণ করছে শান্তিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুত। উপজেলা সদরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে তারা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেয় আর আমাদের বঞ্চিত রাখে। আমরা এমন আচরণের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই। আমাদেরকে নিরবিচ্ছিন্ন না হোক অন্তত ১৫/১৬ ঘন্টা বিদ্যুত দেওয়ার দাবি করছি।
পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় বিশেষ করে জয়সিদ্ধি, বসিয়াখাউরি, বড়মোহাসহ সব এলাকায় বলতে গেলে একেবারেই বিদ্যুত থাকেনা। কোনো রাতে বিদ্যুত নিলে সারা রাতই বিদ্যুত থাকেনা। এমনও সময় যায় প্রায় ৩/৪দিন বিদ্যুত থাকেনা আমাদের এখানে।
ভুক্তভুগী ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন ও মুজিবুর রহমান রিপন বলেন, আমাদের ব্যবসাই হচ্ছে বিদ্যুতের উপর। সারাদিন, রাত বিদ্যুত থাকে না। কখন কাজ করবো? বিদ্যুত না থাকলে আমাদের খুবই ক্ষতি হয়।
শান্তিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের সহকারি ব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. নাদির হোসেন বলেন, বিদ্যুত বণ্টন নিয়ে কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে না। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। আমরা বিদ্যুতের সংকটময় মুহূর্তের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছি। আমাদের চাহিদা যদি থাকে ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি দুই কিংবা আড়াই মেগাওয়াট। তাছাড়া সমস্যাটা এখন জাতীয়ভাবেই হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (জিএম) মো. জাকির হোসেন বলেন, দিনের বেলা বিদ্যুতের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। চাহিদায় ঘাততি থাকলে মাঝে মাঝে বাই রোটেশনে যেতে হয় বা পিক আওয়ারে এমনটা হতে পারে। তখন বাধ্য হয়েই লোডশেডিং করতে হয়। এটাকে আমরা বলি ‘ক্রাইসিস মোমেন্ট’। আবার সব সময় এটা হয় না। দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুত নিয়ে রাখার ব্যপারে তিনি বলেন, দিনে এমনটা হয় না। রাতের বেলা কোথাও লাইন ফল্ট করলে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তখন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া হাওর এলাকায় ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও আমাদের কাজে একটু-আধটু বেগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে রাতের বেলা কাজ করা যায় না।