স্বীকৃতিই তাদের শেষ ইচ্ছা’

নিউজ ডেস্ক নিউজ ডেস্ক

বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ১২:০৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৭, ২০২১ 740 views
শেয়ার করুন

প্রকৃতির মানসকন্যা মৌলভীবাজার জেলার সবুজ স্নিগ্ধ পাহাড়-বেষ্টিত একটি উপজেলা রাজনগর। এই উপজেলার বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রাম পাঁচগাঁও। এই গ্রামের নামেই ইউনিয়ন পরিষদ। ন্যায্য দাবি দাওয়া এবং জাতীয়তাবাদী মুক্তির আন্দোলনে ব্রিটিশ আমল থেকেই এই গ্রামের মানুষের রয়েছে গৌরবজনক ইতিহাস।

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ও বাংলার অনগ্রসর, অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত বিপ্লবী অগ্নিকন্যা লীলা নাগ এর জন্ম এ গ্রামেই। তার পিতা গিরিশ চন্দ্র নাগ ছিলেন একজন স্বনামধন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।ব্রিটিশ ভারতের দেশ প্রেমিক বিপ্লবীরা যে অস্ত্র দিয়ে অত্যাচারী ইংরেজদের প্রতিহত করেছিলেন তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই গ্রামের লৌহকার তথা কামারদের তৈরি বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

 

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের কাটরার দক্ষিণ-পূর্বে তোপখানায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘জাহানকোষা কামান’ এর নির্মাতা তৎকালিন শ্রেষ্ঠ লৌহশিল্পী জনার্দন কর্মকার এই গ্রামেরই সুসন্তান। এভাবেই এই গ্রামের মানুষ তাদের কর্ম, জ্ঞান ও মেধার মনন ঘটিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হয়ে উঠেছিলেন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ।

 

পাঁচগাঁও এর একজন কৃতিমান আধ্মাতিক সাধক সর্বানন্দ দাস৷ তিনি এই গ্রামে ব্যতিক্রমি দূ্র্গা প্রতিমার প্রচলন করেন। প্রায় ৩শ বছর ধরে আজও এই গ্রামে পূজিত হয়ে আসছেন উপমহাদেশের একমাত্র লাল দূর্গা দেবী। ব্যতিক্রমী এই দেবী দর্শনের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন হিন্দু ধর্মালম্বী ভক্তরা।

 

প্রতি বছর ষষ্ঠী থেকে দশমীর বিসর্জনের দিন পর্যন্ত ৫ দিনে দেবী দর্শনে লক্ষাধিক ভক্তের পদচারণায় পবিত্র এ গ্রামটি হয়ে ওঠে কোলাহলময় নান্দনিক। একাত্তরে জাগ্রত এই মন্দিরটি ধ্বংস করার আপ্রান চেষ্টা চালিয়েও মন্দিরটির অবকাঠামোগত কোন ক্ষতি সাধন করতে পারেনি পাকিস্থানি হানাদার ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা।

 

তবে তারা মন্দিরের সোনাদানাসহ সকল মুল্যবান সামগ্রী লুটপাট করে নিয়ে যায় বলে জানা যায়। লুটপাটকারীদের অনেকেই পরবর্তীতে যন্ত্রণাদায়ক জীবন ও বিভীষিকাময় মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলো। ১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ থেকে সারাদেশে পাকিস্তানি হায়েনারা গণহত্যা, ধর্ষন,লুটপাট ও নির্যাতন শুরু করলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকজন ভারতে পাড়ি জমাতে শুরু করেন।

 

কিন্তু পাঁচগাঁও এর দেশপ্রেমিক মানুষ স্থানীয় কয়েকজন চিহ্নিত পাকি-দালাল দ্বারা বারবার হুমকীপ্রাপ্ত হলেও দেশ ছেড়ে কোথাও না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সখ্যতা গড়ে স্থানীয় কিছু দালাল সুবিধা লাভ করতে শুরু করে। তারা শান্তি কমিটিতে নাম লেখিয়ে গ্রামে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার শুরু করে।

১৯৭১ সালের ৭ ই মে গভীর রাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে পাঁচগাও গ্রাম ঘেরাও করে পাক-হানাদার ও স্থানীয় রাজাকাররা। তারা গ্রামের পুরুষদেরকে হাত পাঁ বেঁধে বাবু হিরন দাসের দীঘির পাড়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার চালিয়ে হত্যা করে কমপক্ষে ৫৯ জন্য নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে। তারপর লাশগুলো ফেলে দেয়ে সুগভীর দিঘির জলে। আহত হয়েও সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান কয়েকজন।

কিন্তু এখানেই শেষ নয় ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্টতম গণহত্যাকান্ড শেষে হানাদাররা মেতে উঠে নারী ধর্ষন ও লুটপাটের মতো ঘৃণ্য মহোৎসবে। তাদের হিংস্র কামোল্লাস থেকে সেদিন রেহাই পায়নি কিশোরী, যুবতী,বৃদ্ধা কোনো নারী। একদিকে রক্তের স্রোত অন্যদিকে তারা মেতে উঠে নারী নির্যাতনের দানবীয় কর্মকান্ডে। গ্রামের অসংখ্য নারীরা সেদিন ধর্ষিত হন। হানাদাররা যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন নারীকে।

তাদেরকে গ্রামের একটি বাড়ীতে আটকে রেখে দিনের পর দিন চালায় যৌন নির্যাতন। এবছর স্বাধীনতা লাভের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিলো মহান স্বাধীনতা তাদের অনেকেই আজো রয়ে গেছেন অজানার অন্তরালে।

‘পাঁচগাও শহীদ পরিবার’ এর সভাপতি রুবেল আহমেদ জানান পাঁচগাঁও গ্রামে মাত্র একজন ছাড়া আর কোনো বীরাঙ্গনাই রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না শহীদ পরিবারগুলোও। অনহারে, অবহেলায় দিন কাটছে পাঁচগাঁওয়ের ভুক্তভোগী ও নির্যাতিতদের। বুকে কষ্ট ও যন্ত্রণার পাথর বুকে নিয়ে আজো বেঁচে আছেন একাত্তরের প্রবীণ ৭ জন বীরাঙ্গনা।

তারা হলেন: ১) প্রমোদিনী মালাকার(ওরফে ফুল বিবি) স্বামী: শহীদ সুরেন্দ্র মালাকার। ২) তিলুয়া রবি দাস, স্বামী : কানাই রবি দাস। ৩) ছায়া মালাকার, স্বামী : মাখন মালাকার ৪) মায়া রাণী শব্দকার, স্বামী : শিবুরাম শব্দকর, ৫) মায়া রানী শব্দকর, স্বামী : সুবর্ণ শব্দকর, ৬) গীতা রাণী শব্দকর, স্বামী সুখময় শব্দকর, ৭) সরলা শব্দকর, স্বামী : চরিত্র শব্দকর। তাদের সবার আহত কণ্ঠে এক অভিন্ন কথা- ‘রাস্ট্রীয় স্বীকৃতিই আমাদের শেষ ইচ্ছে”।

এ বিষয়ে কথা হয় রাজনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার সজল চক্রবর্তীর সাথে তিনি জানান এই ৭ জন নির্যাতিতা খুব কষ্ট জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের সরকারিভাবে পূনর্বাসন জরুরি।