সিলেটে আমিঃ নতুন জীবন

প্রকাশিত: ২:১৩ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২০ 1,245 views
শেয়ার করুন

উনিশ শ’ পচাঁনব্বই । সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখ । সদর দপ্তর বিডিআর , ঢাকা’র অপ্স এন্ড ট্রেনিং ডাইরেক্টরেট থেকে স্বইচ্ছায় অকালীন অবসরের সার্টিফিকেট হাতে পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম বিশাল পৃথিবীর পথে । দীর্ঘ ষোল বছরের ইউনিফর্মের চাকুরীর ইতি টানতে হলো অসময়ে, মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে ফিজিক্যালী আনফিট হয়ে ।

ঘটনা অনেক আগের । তখনও আমি সেকটর হেডকোয়ার্টার সিলেট, আখালিয়ায় ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নে । সপ্তাহে একদিন (বুধবার) সকালে পিইটি (ফিজিক্যাল এফিসিয়েন্সি টেষ্ট) করতে হয় । ব্যাটেল ড্রেসে ১৮ মিনিটে দুই মাইল দৌড়ে এসে বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম (ক্রস কান্ট্রি) । এর মধ্যে সিক্স ফিট ওয়াল ডিঙানো, মাংকি রোপ, বার্মা ব্রীজ, জিগজাক, দমদমা থেকে লাফিয়ে নামা ইত্যাদি থাকে । বয়স কম, মনের আনন্দেও করি । দমদমা থেকে লাফ দেয়াটা কঠিন কিছু না, বরং মজার। সিষ্টেমটা হলো উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় প্রথমে ভূমি স্পর্শ করবে পায়ের পাতা । কিন্ত ঝোঁকের মাথায় সেদিন লাফিয়ে পড়ার সময় আমার প্রথম ওজনটা পড়লো পায়ের মুড়ি, গোড়ালীতে। মচকে যাবার মতো ভাব হলো, চাঁপটা পড়লো কোমরে। সোজা হয়ে শরীর ঝাঁকি দিয়ে সামলে নিলাম ।

  • সদর দপ্তর বিডিআর ঢাকায়, মেইন্টেন্যান্স এন্ড কনষ্ট্রাকশন ব্রাঞ্চে পোষ্টিং হয়ে আসার পরে ধীরে ধীরে রি-একশনটা টের পেতে শুরু করলাম । এখানে ইলেক্ট্রিক টাইপ মেশিন, পরে কম্পিউটারে এক নাগাড়ে বসে কাজ করতে হতো । কাজ শেষে উঠে দাড়াতে গেলেই কোমরে ব্যথাটা জেগে উঠতো, পরে ধীরে ধীরে মেরুদণ্ডের দিকে প্রসারিত হলো । পরে এই ব্যথারই চেহারা বদলে গেলো এক সময়ে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি, সেখান থেকে টেকনাফে যাবার পরে প্রথমবার ডাক্তারের কাছে গেলাম । তখন অবস্থাটা ছিলো অন্যরকম। প্রথমে এক পা ভারী হয়ে যেতো । ধীরে ধীরে উপর দিকে উঠতে থাকতো । কোমর ভারী হয়ে যেতো । অন্য পা দিয়ে নামতে শুরু করতো । কোমর সহ নিম্নাংশ ভারী এবং বেদনাবহ হয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে উঠতো সমস্যাটা । যখন তখন চিলিক দিতে শুরু করতো। প্রায় চলৎশক্তিরহিত অবস্থা! সমগ্র মনোবল এক করে উঠে বিছানা থেকে দরজা পর্যন্ত দশ ফিট দুরত্ব অতিক্রম করতে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগতো।

চিকিৎসার জন্য প্রথম মেডিসিনের ডাক্তার, পরে সার্জারীর ডাক্তার কর্ণেল বদরের নিকট রেফার করা হলো আমাকে। চিকিৎসা চললো। ইতোমধ্যে বদলী হয়ে অপস এন্ড ট্রেনিং ডাইরেক্টরেটে চলে এলাম। চিকিৎসা চলছে। অবশেষে মেডিক্যাল বোর্ড আমার এই অসুখ নিরাময়-অযোগ্য বলে একমত হয়ে আমাকে ক্যাটাগরী ‘সি (ইই)’ ঘোষণা করলেন ।

ক্যাটাগরি ‘সি (ইই)’ মানে নরমাল ফিজিক্যাল ওয়ার্কে অসমর্থ । আমার কাজ তো অফিসিয়াল । দায়িত্বের হেরফের হবে না, কিন্তু প্রমোশনের সময় যে কোর্স করতে হয়, সেখানে ফিজিক্যাল ফিটনেসের দরকার হয়। সুতরাং আমার প্রমোশনের সম্ভাবনা আর রইলো না, অথচ আমার বিগত দুই বছরের এসিআর এ (এনুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট) ‘outstanding’. মনোবল ভেঙে গেলো আমার। স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে প্রি ম্যাচিউরড রিটায়ার্ডমেন্টের আবেদন করলাম ।

আবেদন মঞ্জুর হলো ।

উনিশ শ’ পঁচানব্বই সালের অকটোবর। সময় বিকেল প্রায় তিনটে হবে। জিন্দাবাজার রাজা ম্যানসনের তিনতলায়। অনুপ্রাস এডের অফিসে ঢুকেই ধপ করে বসে পড়লাম সামনে যেই চেয়ারটা পেলাম, সেখানেই।
বিডিআর থেকে সদ্য অবসর নিয়ে আমি সিলেটে। আবু আইউব কমল আনসারীর Abu Ayub Ansari ডাকে। ওর উদীয়মান বিজ্ঞাপনী সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসাবে সহায়তা করার জন্য।

দ্বিতীয় দিনেই দেখা হলো সুফিয়ান আহমেদ Sufian Choudhury চৌধুরীর সাথে। অনুপ্রাসেই। আসলে আমি সিলেটে এসেছি শুনেই ছুটে এসেছেন তিনি। লেখক এবং লেখালেখির ব্যাপারে সুফিয়ানের আন্তরিকতা প্রশ্নাতিত। এখনো। সুফিয়ান আহমেদ চৌধুরীর সাথে এটা আমার প্রথম দেখা, মুখোমুখী। কিন্তু আমরা পরিচিত তারুন্যের প্রথম বেলা থেকে। সৈয়দ নাহাস পাশা, শাহাদাৎ করিম, তুষার কর, তমিজ উদ্দিন লোদী, নিখিল রায় পূজন Nikhil Roy Pujan , অজিত রায় ভজন Ajit Roy Bhajan , আবুল কাশেম মিলু Milu Kashem , হোসনে আরা হেনা Hosneara Hena , আব্দুল বাসিত মোহাম্মদসহ আরো অনেক বন্ধু, লেখালেখিতে যারা অতি কাছের, প্রাণের, কিন্তু চোখের দেখা হয়নি কখনো। লুৎফর রহমান রিটন Lutfor Rahman Riton এই সিলেটি লেখক বন্ধুদের কথা লিখেছেন তার অনবদ্য অননুকরনীয় বর্ননায় তার ‘ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী’ নামের চমৎকার গ্রন্থে। অবশ্য সেখানে আমাকেও সিলেটি হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, উল্লিখিত বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারনেই।
সুফিয়ান ভাইর সাথে কথা হলো। সিলেটের লেখক বন্ধু এবং পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানলাম। ঐ সময়েই আইডিয়াটা এলো মাথার মধ্যে। সব সিডিউল অফ করে দিয়ে এক সপ্তাহের জন্য ডুব দিলাম। এই সময়টা কাটলো কমলের বেডরুমে স্তুপ করে রাখা গত দশ বছরের সিলেট থেকে প্রকাশিত পত্র পত্রিকা আর লিটলম্যাগ ঘেটে। বিবাহ স্মারকগুলিও বাদ দেইনি।
ঠিক দশ দিনের দিন সিলেটের প্রায় সব লেখকই নড়ে উঠলেন,
‘এই মোসলেহ উদ্দিন বাবুল কে?’

  • আসল ঘটনা হলো দৈনিক মূক্তকন্ঠের সাপ্তাহিক সাপ্লিমেন্টারী ‘সোনার সিলেট’ এ প্রকাশিত আমার লেখা একটি ফিচার, ‘সিলেটের সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চা’। বেশী চাঁপটা গেলো জিন্দাবাজার ওভারসিস সেন্টারে মূক্তকন্ঠ প্রতিনিধি ইকবাল কবির Iqbal Kabir ভাইর অফিসের দিকে। আমার জানার সীমাবদ্ধতার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ পড়েছে, তাদের তো খারাপ লাগবেই। তবে ফিচারটার মূল থিম ছিলো ‘ইতিবাচকতা’। যা সিলেটের শতধাবিভক্ত সাহিত্যসেবীদের জন্যে ছিল ‘অভিনব’!

এই ফিচারটাই প্রায় সব মতের লেখকদের বন্ধুত্বের দুয়ার খুলে দিয়েছে আমার জন্য। যাদের অনেকেই যোগ্যতায় আমার চেয়ে অনেক উঁচুস্তরের প্রতিভাবান!

১৯৮১ থেকে ৮৩ পর্যন্ত আমি সিলেটে ছিলাম। চাকুরীতে। প্রথমে জকিগন্জ আটগ্রাম। পরে বিডিআর আখালিয়ায়। তখনো লেখা ছাপা হতো আম্বরখানার সাপ্তাহিক যুগভেরী, কাষ্ঠঘরের একটা সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক দেশবার্তা, সুবিদবাজারের মাসিক সুর এবং দৈনিক সিলেটের ডাক এ। লেখা পাঠাতাম ডাকে।
নিরাপত্তার ঘেরাটোপের চাকুরী থেকে ঘরের পাশে থাকা কোন বন্ধুর সাথেও প্রত্যেক্ষ যোগাযোগ হয়নি আমার। শুধু আবুল কাশেম মিলুর (মিলু কাশেম) ছোট ভাই আবু নাসের দিলু (দিলু নাসের) Dilu Naser ছাড়া। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ এই ভাইটি তখন নাড়াচাড়া দেয়ার মতো ছড়া লিখে যাচ্ছে দু’হাতে।
উইকএন্ডের এক সকালে সে আখালিয়ায় আমার ডর্মিটরিতে এসে আমাকে আবিস্কার করে ফেললো! দিলুর সাথে সেই দেখার পরবর্তি মনে রাখার মতো কথাগুলো লিখবো বারান্তরে।

ক’য়েক মাস পরেই কোয়ান্টাম মেথডের কোর্স এর ঘোষনা দেখলাম সিলেটে । মেডিটেশন শেখার এই কোর্স করার আগ্রহ আমার আগে থেকেই ছিলো । মহাজাতকের ‘কোয়ান্টাম মেথড’ বইটি আগে থেকেই পড়া ছিল ।

থাকতাম সুবিদ বাজার, লন্ডনী রোডে । অফিস জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশনে । প্রতিদিনই রিকসায় করে আসা যাওয়ার পথে খুব মনোকষ্টে ভূগতাম । আমি রিকসায় উঠতে এবং নামতে যেই কষ্টটা করতে হতো, আমার ধারনা এমন অভিজ্ঞতা কারোরই নেই ! কারন এতোটা অসুস্থতাকে ধারন করে এমন স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরার চেষ্টা করে, এমন কারোর কথা আমি শুনিনি । রিকসায় বসে যখন রিক্সাওয়ালাকে স্বাভাবিক মূভমেন্ট করতে দেখতাম, তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা করতো , হে আল্লাহ, আমাকে যদি এমন রিকসাওয়ালার জীবন দিতে, আমি মহা ভাগ্যবান মনে করতাম নিজেকে ।

আম্বরখানার হোটেল পলাশে সকাল সন্ধ্যা চারদিনের প্রশিক্ষণ। কোয়ান্টাম মেডিটেশনের পঞ্চান্নতম গ্রাজুয়েশন কোর্স। সীতাব আলী ভাইর অর্গানাইজড । প্রথম দিন থেকেই ভিন্নরকম অভিজ্ঞতার শুরু । চতুর্থ দিনের অভিজ্ঞতা তো অভাবনীয়, চমকপ্রদ ! আমার জন্য অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা!
আমার অসুখটা আর নেই !
কোয়ান্টাম মেডিটেশনের উদ্ভাবক মহাজাতক এখনকার মতো তখন অতো দুরের মানুষ ছিলেন না। তিনি স্বয়ং হাতে ধরে পজিশন ঠিক করে দিতেন, পাশে দাঁড়িয়ে সমাধান দিতেন যে কোন সমস্যার।

এরপরেও এমন কিছু নাটকীয় অভিজ্ঞতা আমি লাভ করতে শুরু করলাম, যা বাস্তব বলে নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না । অদ্ভূত, অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য ! আমি এখনো সুস্থ, দুর্ঘটনাটা ঘটার ঠিক আগের জীবনের মতো ।

এখন কিন্তু অতোটা অবাক লাগেনা …