লাল শাহ’র মানুষ উৎসব: সব আনন্দই মানুষের

প্রকাশিত: ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০২৪ 79 views
শেয়ার করুন
আমি তাঁকে ‘ভাব ফকিরের’ মতোই দেখেছি। ঘরদোর নেই, পায়ে জুতো নেই, ঘরে চাল-ডালের আভিজাত্য নেই, উশৃংখলতা নেই, অহংকার নেই। এতো নেই এর মাঝে আছে মানুষের ভালোবাসা। আছে গান, আনন্দ আর বিনয়। আছে উৎসবের মাখামাখি। মানুষ উৎসবে লাল শাহ’র এমন অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখেছি পহেলা মার্চ রাতে। একদম মাটির মানুষ, একেবারেই মাটিতে মেশা মানুষ তিনি। কাছে গেলেই মনে হয় গা থেকে মাটির ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। তাঁর শরীরের এমন মাটির ঘ্রাণ নিতে ভারত থেকে অর্ধ ডজন গুণি শিল্পী এসছেন তাঁর মানুষ উৎসবে। উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া থেকে এসে আসন পেতেছেন লাল শাহ’র বাড়িতে। তাঁরা জীবনকে নিয়ে যাচ্ছেন ভাব তত্ত্বের নিগূঢ় আখড়ায়। লাল শাহ’কে নিয়ে মানুষের কি দারুণ আহ্লাদীপনা। ঈর্ষনীয়! ইদানিং ভাব জগতের এমন সুন্দর আয়োজন যেখানে ক্রমেই কমে যাচ্ছে সেখানে লাল শাহ’র বাড়ি শান্তিগঞ্জের উজানীগাঁওয়ে মানুষ উৎসব প্রকৃত মানুষকে দিচ্ছে জীবনের খোরাকি। দুই পর্বের এ গানের অনুষ্ঠানে অনেক কিছুই ছিলো বিশাল ব্যতীক্রম। সচরাচর ওরস কিংবা গানজলসায় আমরা যা দেখি তা ছিলোনা মানুষ উৎসবে।
তেত্রিশ বছর ধরে লাল শাহ’র বাড়িতে এ অনুষ্ঠান হচ্ছে। লাল শাহ’র বাবা, মারিফতি মানুষ ফকির আবদুল কুদ্দুছ ও তাঁর মা ছায়াতুন নেছা এ অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষন করতেন। এখন করেন লাল শাহ। লাল শাহকে বলেছিলাম, আপনাকে এখন ফকির উপাধিতে ভূষিত করবার সময় এসেছে। আমি অতি নগন্য মানুষ। আমার দ্বারা এ বিশাল শব্দকে স্থায়ী করা সম্ভব হবে না। কিন্তু আপনিই বর্তমান জগতের এখন প্রকৃত ভাব ফকির। আমরা এমন ফকির এখন আর দেখতে পাই না। সুষ্ঠুভাবে টিকে থাকতে হলে সমাজে এমন ভাব ফকিরের খুবই দরকার। মানুষ উৎসবে দেশ বিদেশের অনেক মানুষকেই দেখেছি মানুষ হয়ে যেতে। সীমানার অপারের বেশ ক’জন মানুষ কত সহজেই মিশে গেলে উজানীগাঁও গ্রামের মাটি, নদী, পানি, মাছ আর হাওরের সাথে। গান কি বিশাল বিষয়! বহু জাতির মানুষকে একটি মঞ্চে এক করে তুলে। মানুষকে হাসায়, কাঁদায়। এসবই তো প্রয়োজন। উজানীগাঁও গ্রাম মানুষ উৎসবের জন্য প্রতি বছর মুখিয়ে থাকেন। আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যায় সেদিন। গ্রামের মহিলারা লাল শাহকে এক ডিবি করে চাল দেন। সমস্ত গ্রাম ঘুরে ঘুরে সে চাল সংগ্রহ করা হয়। সকলের সম্পৃক্ততায়  লাল শাহ’র আয়োজিত এ মানুষ উৎসব বাস্তবায়ন হয়। সার্বিক সহযোগিতায় থাকেন গ্রামবাসী। আমি দেখেছি, সকল মানুষ কীভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ উৎসবকে সফল করে তুলেন। গ্রামের মুরব্বি শাহ নূর থাকেন সমস্ত অনুষ্ঠানের সভাপতি। লাল শাহ বলেন, ‘আমার বলতে কিছু নেই। আমি শূণ্য, নিঃস্ব এক ফকির মানুষ। মানুষের এ উৎসব উজানীগাঁও গ্রামবাসীর। আমি সকলের খাদেম।’
মানুষ উৎসবে অনেক মানুষ দেখেছি। বহু মানুষ আমার এবং আমাদের নজর কেড়েছেন। বহু শিল্পী এসেছেন সিলেট থেকে। শোনেছি, সবাই এসেছেন বিনা পারিশ্রমিকে। নিজ ইচ্ছায়। লাল শাহ যে কাজটি করেছেন, সেটি হচ্ছে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। প্রগতিশীল মানুষদের আখড়া ছিলো অনুষ্ঠান মঞ্চ। সবাই গানে জ্ঞান আহরোন করতে এসেছিলেন। তত্ত্ব গানে ডুব দিতে এসেছিলেন। আমিও এমন উদ্দেশ্য নিয়ে লাল শাহ’র বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম। কি আন্তরিকতা, কি প্রেম আর ভালোবাসা দেখিয়েছেন লাল শাহ ও তাঁর সহধর্মিণী সাজিনা বেগম। সাজিনাও একজন শিল্পী। গান করেন তবে অনিয়মিত। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কীভাবে করতে হয় তা খুব ভালোভাবেই জানেন এই শিল্পী দম্পতি। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব সাজানো হয়েছিলো ধামাইল গান দিয়ে। রাত সাড়ে ৮টার আগ পর্যন্ত ধামাইল গান ও নৃত্যে মানুষ আনন্দ খুঁড়িয়েছে। আমার প্রথম দর্শন শান্তিগঞ্জের যুবকদের নিয়ে গঠিত ব্রজকিশোর ধামাইল দলের গান-নৃত্য। দারুণ যে বিষয়টি আমার আলাদা লেগেছে তা হচ্ছে উৎসব সম্মাননা স্মারক ও কৃতজ্ঞতা পত্র। আমরা যে শক্ত কাগজটিকে সনদপত্র বলি অতি বিনয়ের সাথে ফকির লাল শাহ এই কাগজটিকে কৃতজ্ঞতা পত্র বলেছেন। ক্রেস্টকে বলেছে উৎসব স্মারক। একজন শিল্পী গান পরিবেশনের পর বিনয়ের সাথে অনুরোধ করা হয় মঞ্চে থাকার। তারপর একজন গুণি ব্যক্তিকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। শিল্পীকে তুলে দেওয়া হয় উৎসব স্মারক ও কৃতজ্ঞতা পত্র। সাথে থাকে একটি খাম। খামে হয়তো সম্মানি। সেটা কত তা আর জানতে চাইনি। কারণ এর আগে যা দেওয়া হয়েছে তা-ই তো অনেক কিছু। একজন শিল্পীর শিল্পী হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তাও আবার লাল শাহ’র মত মানুষের হাত থেকে। এটাই বা কম কিসের? ধামাইল গানে বাদ্যযন্ত্র বলতে মন্দিরা, ঢোল আর হারমোনিয়াম। ধামাইল ছাড়াও গান হয়েছে তখন। পাগলার স্নেহা দাশ তুলি ও তেঘরিয়ার শিল্পী ষষ্ঠী দাশ শুভশ্রী গেয়েছেন তখন। তাদের হাতর কৃতজ্ঞতাপত্র  তুলে দিয়েছেন যথাক্রমে ভারতের চব্বিশ পরগনার গুণি শিল্পী শেখর দাশ ও লাল শাহ সংগীতালয়ের সভাপতি, গীতিকার এম এ ওয়াদুদ। এরপর একটি চমৎকার ছড়াগান পরিবেশন করেন লাল শাহ’র পুত্র আবদুর রহমান। আবদুর রহমান নামটি সম্ভবত বাউল করিম শিষ্য, জলসুখার বিখ্যাত বাউল আবদুর রহমানের নামে অনুপ্রাণিত হয়ে রেখেছিলেন লাল শাহ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় রাত সাড়ে ৯টায়। তখনো মানুষের তেমন সমাগম ঘটেনি। লাল শাহ’র আরেকটি জিনিস খুবই নজর কেড়েছে আমার আর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার। কিছুক্ষণ পর পর আগর বাতি জ্বালিয়ে চারদিকে হিছার করছেন। হিছার আমাদের অঞ্চলের শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ প্রদক্ষিণ করা। তবে এখানে যে অর্থে তিনি প্রদক্ষিণ করছেন সেটাকে হিছার বলাই যুক্তিযুক্ত। হিছার শব্দের একটি আধ্যাত্মিক নিগূঢ়তা আছে। গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছেন সবার উপরে। মৃত্যুর সাথে জীবনের কী বাস্তব সংযোজন।
“দয়া করো দয়াল তোমার দয়ার বলে
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে
জীবন-সাফল্য তোমায় পাইলে–
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে॥’’
ফকির লাল শাহ’র বাবা-মা এমনকি তাঁর নিজেরও গুরু ছিলেন শাহ আবদুল করিম। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে তার ভাব সংগীত দিয়ে। লাল শাহ অতি দরদ দিয়ে গেয়েছেন গানটি। দর্শক টেনেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। জড়ো হতে থাকেন সাধারণ মানুষ। সম্পূর্ণ মানুষ উৎসবে মঞ্চ পরিচালনা করেছেন কবি মেকদাদ মেঘ। সিলেটে থাকেন। খুবই সজ্জন কবি। আমাকে খুব স্নেহ করেন। মাইকে আমাকে যখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন বিশেষণ হিসেবে যে শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছিলেন তার যোগ্য আমি নই। তারপরই তত্ত্ব গান নিয়ে আসেন ভারতের নদীয়া থেকে আসা শিল্পী চৈতন্য কুমার মন্ডল। তিনি গাইলেন- লালন সাঁইয়ের এই মানুষে সেই মানুষ আছে। গানে মানুষকে স্তুতি করার যে আবেদন তিনি রেখে গেলেন স্রোতাদের তা ভাবাবে দীর্ঘদিন। তারপর সাধক আবদুল করিমের আরও একটি গান পরিবেশ করলেন তিনি। তিনি গাইলেন, বলে বলুক লোকে মন্দ, করিও না রাও…. মানুষকে বিমোহিত করে ফেললেন তিনি। হাততালি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। গাইলেন, নদীয়ার বিপদ ভঞ্জন মালাকার। তারপর সিলেটের শিল্পী নন্দলাল গোপ গাইলেন, তোমার মত দরদী কেউ নাই। রাতের সাতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষ। লোকে গিজ গিজ করছে লাল শাহ’র উঠোনজুড়ে। আনন্দ যেনো আঁছড়ে পড়েছে লাল শাহ’র উঠোনে। এমন আনন্দঘন পরিবেশে একে একে গাইলেন পূর্ণিমা, শীতল কান্তি দাশ, শফিকূন নূর, কুলসুমা ও উত্তর চব্বিশ পরগনার বাউল শেখর দাশ। দরদ দিয়ে গাইলেন তিনি। জগন্নাথপুরের রিপন উদাসী জীবন্ত করে তুললেন তার মরহুম উস্তাদ মকদ্দছ আলম উদাসীকে। জীবদ্দশায় যিনি কিনা জেলা প্রশাসকের দেওয়া ঘর নেননি। তিনি বলেছিলেন, অস্থায়ী এ পৃথিবীতে ঘরের কি দরকার? রিপন উদাসীর কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন নিভৃতচারী এই মরহুম বাউল। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি লিখেছিলেন,
“বাঁশ তাকি ছিংলা বড়
জ্ঞানীর মাথা ঘুরাইছে
চেঙ্গের মুল্লুক ব্যাঙ্গে খাইলিছে।।”
 
এমন চরম বাস্তব ও সমকালীন লেখা মকদ্দুছ আলম উদাসী অনেক আগেই লিখেছিলেন। রিপন উদাসী একজোড়া গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। খুব ভালো গেয়েছেন। তিনি একাধারে দোতার বাধকও। এর পর গাইলেন মেঠোসুর সম্পাদক, কবি ও প্রকাশক বিমান তালুকদার। তার গানে দেখার হাওর, ধান-মাছ আর প্রাণ-প্রকৃতির কথা উঠে এসেছে। বিমান তালুকদার কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে চাইলেন। কিন্তু গানের আসরে আলোচনা তেমন চলে না বলেই বোধহয় মঞ্চে ডেকে নিলেন লাল শাহ’র স্ত্রী সাজিনা বেগমকে। সাজিনা বেগম গান করছিলেন সময় সিলেট থেকে আসা ছোট্ট সোনামনিরা স্টেজে উঠে মনের আনন্দে নাচতে থাকলো। আকর্ষণ চলে গেলো তাদের প্রতি। বেশ দৃষ্টিনন্দন লেগেছে তাদের নাচ। তখন রাত ১টার উপরে। মানুষে মানুষে তখনো গিজগিজ করছে। তেঘরিয়ার দোলন তালুকদার দাদা, গীতি কবি নিকুঞ্জ সূত্রধর পুরোটা সময় সাথে ছিলেন। উপরি দোকানগুলোর বাজার গরম ছিলো। তখনো অনেক শিল্পী গান গাওয়া বাকী। আমাদের চলে আসতে হবে। ভোর রাত পর্যন্ত গান হবে। আসার আগে মানুষ উৎসব নিয়ে গ্রামের মানুষের উপলব্ধি বুঝবার একটু চেষ্টা করি। মুরব্বি মকদ্দুছ আলী ও সেফাল মিয়া নামের দু’জনের সাথে কথা বলি। তারা জানান, এই অনুষ্ঠানটি লাল শাহকে কেন্দ্র করে হয় ঠিক কিন্তু অনুষ্ঠানটি আমাদের সকলের। এ দিন আমাদের গ্রামে উৎসব থাকে। অনেক মানুষ আসেন আমাদের গ্রামে। লাল শাহ’র বাড়িতে ভারত থেকে মানুষ আসেন। আমাদের সাথে কথা হয়। তারা গান করেন। মাটিতে বসেন৷ আমরা উপভোগ করি। আমাদের খুবই ভালো লাগে। এই উৎসব আমাদেরও উৎসব। আমাদের গ্রামের মানুষ এক ডিবি করে চাল দিয়ে মানুষ উৎসবে শরিক হই।
লাল শাহ তো ফকির মানুষ। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে মুল্যায়ণ করেন। করজোড়ে মূল্যায়ণ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীটা মানুষের হোক। এই আয়োজন মানুষদের জন্য। গ্রামের মানুষ আমার মাথার মুকুট। তাঁরা সহযোগিতা না করলে আমি নগন্যের দ্বারা এসব সম্ভব হতো না। ভারত, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে যে যে মানুষগুলো উৎসবে সামিল হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
 
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।