এই হরিণ মেয়েটার নাম কুসুম, আমার আম্মু

জাহান রিমা জাহান রিমা

লেখিকা, আমেরিকা

প্রকাশিত: ১:০৪ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২০ 511 views
শেয়ার করুন

দুধে আলতা গড়নের কুসুমের বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণচূড়া গড়নের যুবক শাহজাহানের সঙ্গে। কুসুমের এই এক দুঃখ! দাঁড়ালেই শাহজাহানের বুকের কাছে মুখ। উচ্চতায় দুজন সমান হলে কী এমন ক্ষতি হতো। যদিও কুসুমের মনের উচ্চতা শাহজাহানের বুক উচ্চতা ছাড়িয়ে। শাহজাহান সেটা বুঝে গিয়েছিল খুব দ্রুত। কুসুমের উচ্চতা দৃশ্যত যত, অদৃশ্যে তার থেকেও বেশি। বিয়ের পরেও কুসুম পড়তে চায়। শাহজাহান কুসুমের ব্যাকুলতা বোঝে। কিন্তু হাজারটা প্রতিকূলতাকে ঠেলে কোন সাহসে সহাস্যে বলবে এই নিরক্ষর সমাজকে? কুসুম পড়বে!

শাহজাহান বড় ছেলে, পাহাড় সমান দায়িত্ব কাঁধে। ঘর ভর্তি আটটা দেবর-ননদ আর শ্বশুর-শাশুড়ি। তার সঙ্গে একটা অজপাড়া গ্রাম। যেখানে বউদের আলাদা নাম থাকে না, সেখানে পড়াশোনা করবে বাড়ির বউ, সে তো রীতিমতো অপরাধ!

কুসুম আমার আম্মু।
এমন করেই বেশ কটা বছর কাটল। তত দিনে বেণি দোলানো মেয়েটার পড়াশোনা নামক অপরাধ করতে চাওয়ার কারণে গভীর কাজল লেপ্টে কালি। তখন অমাবস্যা। আমার দাদাভাই কী জানতেন তার পরেই পূর্ণিমা। মধ্যরাতে তিনি হুংকার করে ওঠেন। বের হয়ে যাও তুমি, বউমা যাও, কুসুম যাও। চড়ুই পাখির মতো কাঁপতে থাকা কুসুম বিস্ময়ে তাকিয়ে তার শ্বশুরের দিকে, আমার দাদাভাইয়ের দিকে। আব্বা, যাব! দাদাভাইয়ের গলা যেন গলা নয়, জাহাজের ডাক! যাও, আমি বলছি যাও। খড়কুটোর চিন্তা করতে হয় না, তুমি খড়ের গাদা বানানোর চিন্তা করো। আমিই দরজা খুলে দিলাম, কার সাহস আছে দেখি, তোমাকে আটকায়।

আমার নিরক্ষর দাদুর (দাদি) মুখ ভার। পড়াশোনা করলে বউরা খারাপ হয়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় বিস্ময়। বাড়ির বড় বউয়ের এই দশা। তবু কুসুম বের হয়ে গেল, কুসুমের একলা পথ, একার হাঁটা। সময় এক পাগলা ঘোড়া। এরই মাঝে কুসুমের ঘরে দুই সন্তান। নিপু-সুমন। কুসুমের তাদের নিয়েই এইচএসসি শেষ হয়। যে রাতে কুসুমের পরীক্ষা কেবল সে রাতেই তাদের অসুখ বাঁধে। হায়রে কষ্ট। তাতে কী, কুসুম নির্ঘুম থাকার মন্ত্র শিখে গেছে। তাকে অসুখের বাধা বাঁধতে পারে না। সংসার, সময়, সন্তান থেমে তো কিছুই নেই। সময়ের কোলে চড়ে কুসুমের ঘরে আসে তৃতীয় সন্তান—দীপু। তাকে কোলে নিয়েই কুসুমের বিএর জন্য পড়াশোনা। হায়রে ব্যস্ততা। কুসুম ব্যস্ততার পায়ে চুমু দিতে জেনে গেছে। কুসুমের এই সন্তানটা একটু মা–ঘেঁষা। মায়ের সঙ্গে বায়না ধরে কলেজে যাবে, তাকে নিতেই হবে, নিতেই হবে। দীপুকে করিডরে রেখে এক পলক দীপুকে দেখে অন্য পলক খাতায় রেখে কুসুমের বিএ শেষ হয়।

অতপর মাস্টার্স কড়া নাড়ে। তারপর ফ্যামিলি প্ল্যানিং স্বাস্থ অধিদপ্তর থেকে এম, সি, এইচ-এফ, সি, করা- ইতিমধ্যে চাকরিও হয়ে যায় ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের ভিজিটর পদে। কুসুমের দৌড়ঝাঁপ একদিকে ট্রেনিং অন্যদিকে পড়াশোনা। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় থাকা। সঙ্গে হোস্টেলের জীবন। সে জীবন ডালের সঙ্গে পানির নয়, পানির সঙ্গে ডালের। এমনই করুন। সে জীবন এমনই জীবন; দুধে ভাতে বড় হওয়া কুসুম হোস্টেলের মাংস দেখে ধারণা পেয়ে যায় তাবিজের সাইজ কাকে বলে। শাহজাহানের কাছে এলেই সেসব কথা সকরুণ স্বরে ঝরে পড়ে।

এমনই এক আবেগী সময়ে জানান দিল কুসুমের ঘরে আসবে আরও দুই সন্তান। তাও আবার যমজ। হায়রে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের পরামর্শদাতা! অতপর পৃথিবীতে এলাম আমি আর রিপা। এই দুধের বাচ্চাদের রেখে কুসুমের অন্য জেলায় ট্রেনিং। আবার ছুটে চলা। আরও অনেকটা পথ বাকি। ক্লান্তিতে যখন কুসুমের চোখ মেলে রাখা দায় সেই মধ্য সমুদ্রে হঠাৎ চোখে জল ছিটা। কুসুম ওঠো, পড়া আছে তোমার। সেই জলের ছিটা দেওয়া, মায়ের অবর্তমানে দুধের বাচ্চাদের ফিডার নিয়ে বসে থাকা, তাদের মাকে মানসিক সহায়তা করা, বুকের কাছে রাখা কুসুমের মুখের কথা বুঝতে পারা মানুষটা শাহজাহান। আমার আব্বু।
আমি বুঝতে পারি তখনই, যখন দেখি এই মানুষটা সেই মানুষ। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যার হাতে ফিডার ছিল; আজ সেই হাতের অনামিকায় স্বর্ণের একটা আংটি। সেই বেণি দোলানো ছোট্ট কুসুম পড়াশোনা কমপ্লিট করার পরে প্রথম চাকরির প্রথম উপার্জনে আব্বুকে দিয়েছিল এই উপহার। আজও যখন আব্বুর হাতে আংটিটা দেখি, আমার বুক ভেসে যায় সুখের জলে। আহা, বুঝি এই এক চিহ্ন, এই এক সোনালি শামিয়ানা, যে অকূল সমুদ্রে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কুসুমকে বলেছিল, উহু ডুবে যাওয়া চলবে না কুসুম।

না, কুসুম ডুবে যায়নি। কুসুমের চাকরিজীবন চলেছে। সঙ্গে চলেছে আরও বহু কিছু। একান্নবর্তী সংসারে কত কিছুই তো থাকে। উত্তর বাড়ির পচা আদা, দক্ষিণ বাড়ির অপরিপক্ব রসুন, নিজ ঘরের পেঁয়াজের ঝাঁজ। এসব নিয়েই জলের বুকে জলের চলন, দিনের সন্তরণ। এর ভেতরেই বছর বছর আবাস বদল। কুসুমের চাকরি সূত্রেই সরকারি বাসা। আমরা সবাই সে বাসায় থাকি। মেহমান আসলে আমাদের থাকতে কষ্ট হয়। তখন একটু কষ্ট করেই থাকি। তখনকার সময়ে রহমতপুর গ্রামে রাত নয়টা মানে গভীর রাত।

এমন এক রাতে কুসুম অত্যাশ্চর্য একটা কাণ্ড করে ফেলে। কাউকে না বলে তার শ্বশুর, আমার দাদাভাইকে নিয়ে চলে যায় দূরে কোথাও। যেখানে মাঠের পরে মাঠ। জমির পরে জমি এমন এক নির্মল জায়গায়। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে কুসুম দাদাভাইয়ের হাত ধরে সেদিন আর চড়ুই নয়, বাবুই পাখির দৃষ্টি নিয়ে বলে, আব্বা, আপনি আমাকে সে রাতে বের হতে বলেছিলেন পড়াশোনার জন্য। আজ আমিই আপনাকে বের করে এনেছি। আমাদের সরকারি বাসা। সবাই আসলে থাকতে কষ্ট হয়। একটা সময় অবসরে গেলে এই বাসাও আর থাকবে না। এই দেখেন, এই আমার জায়গা আমার। আমি কিনেছি। এখানে আমার নিজের বাড়ি করব। জমির চারপাশে ৪০টা নারকেল গাছ রোপণ করেছি। এরা বড় হবে! ছায়া দেবে, খুব বেশি সমস্যায় পড়লে এরা রোজগারও করবে। এই যে মধ্যে যে জায়গা, এখানে পুকুর হবে। পুকুরের অপর পাশে যে বাসা হবে সেটা ভাড়া দেওয়া হবে।

এই ভাড়া বাসা এই জন্যই, আমি আর আপনার ছেলে চাকরি আর ব্যবসা বাণিজ্য থেকে অবসর নিলেও কারও ওপর নির্ভরশীল হব না। তারপর অনেক বছর কেটে গেল। কেউ না জানলেও আম্মু জানত সেদিন এদিনে এসে পৌঁছাবে। কিন্তু জানত না নির্ভার হওয়ার সেই কথা শোনা আমার দাদাভাই তার বাস্তবায়ন দেখার জন্য আর বেঁচে থাকবেন না। দাদাভাই বেঁচে নেই। তবে আজ সেই দিন।

আমার আম্মু এ বছর রিটায়ার করবে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদ থেকে। আম্মুর কি মন খারাপ? আম্মু কি এখনো গুন গুন করে নিজের তৈরি করা বাড়ির জলচৌকিতে বসে সে কবিতা বলে, যেটা বলে ঘুম পাড়াত আমাদের? ওই যে, বাবার বাড়ি এই গাঁয়ে, শ্বশুর বাড়ি ওই। তোমার বাড়ি কইগো নারী, তোমার বাড়ি কই? যেমন পরের বাড়ি বাস করে চড়ুই। আচ্ছা এই কবিতা কি আম্মুর প্রিয় নাকি অপ্রিয়।

আমি আজ ভিন্ন মহাদেশে থেকেও প্রযুক্তির আশীর্বাদে আমার থেকে সাত সমুদ্র দূরে থাকা, কিছুদিনের মধ্যে অবসর নিতে যাওয়া কর্মকর্তা মোহছেনা বেগম কুসুমকে দেখছি। কী আশ্চর্য; আব্বু কিভাবে যেন বিয়ের আগে কনে দেখতে দেয়া আম্মুর এই সাদাকালো ছবিকে সোনালী পেন্সিলে এঁকে রঙ্গিন করে এনেছে!

দেখছি অপলক, আত্মপ্রত্যয়ী কাজলে ভরপুর আমার আম্মুর চোখ। আম্মুর সে চোখে কি কান্না আছে। নাতো, আমি বিস্ময় চোখে চেয়ে আছি। চল্লিশ বছর আগের এসএসসি পাস করা সেই বেণি দোলানো ছোট্ট মেয়েটার দিকে। যার মুখে এখনো সেই একই হাসি। যাকে সে পরাজিত হতে দেয়নি। কিছুতেই দেয়নি। যার পৃথিবীর মানুষেরা জানে, কাননে কুসুম কলি সকলই ফুটিল।

 

জাহান রিমা, ফ্লোরিডা (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে