“ধর্ষণ, ধর্ষক, ধর্ষিতা এবং সরকারের প্রতি নছিয়তনামা”

প্রকাশিত: ৭:১৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০২০ 536 views
শেয়ার করুন

রবি ঠাকুরের ভাষায়, অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তরে যেন তৃন সম দহে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো বলেন “অবিচার করার চেয়ে অবিচার সহ্য করা অধিক অসম্মানজনক”।  হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, “জালেমকে শাস্তি দাও, মজলুমকে রক্ষা করো ও আদর্শের তরবারি ধরো, প্রয়োজন হইলে মরো কিন্তু ইসলামের তরবারি নিরপরাধকে আঘাত করিবার জন্য নয়”।

বাংলাদেশে গাণিতিক হারে শিক্ষার সনদ বাড়িয়ে চলেছে। গুণগত শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কারণ দিন দিন শিক্ষাব্যবস্থার যে নৈতিক মূল্যবোধ ছিল তা কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ দলবাজি। দলীয় চাটুকারীতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত যোগ্যতা সম্পূর্ণ বা মেধা সম্পূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না। আর এ ব্যর্থতার দায় কিন্তু রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের উচিৎ ছিল আদর্শ শিক্ষক, মেধা, যোগ্যতা, পারিবারিক শিক্ষা, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি গুণ সম্পূর্ণ মেধাবিদের যাচাই বাছাই করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া কিন্তু কালক্রমে এসব গুণাবলী সম্পূর্ণ শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছেনা। শুরুতেই দলকানা, চাটুকার, চরিত্রহীন, পারিবারিক ঐতিহ্য, না দেখা চুরি, চামারী এসব শিক্ষকরা যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাচ্ছেন সেহেতু এসব গুণ সম্পূর্ণ শিক্ষকদের কাছ থেকে আদর্শ ছাত্র সুশিক্ষা অর্জন করবে কেমনে ? নীতি নৈতিকতার বালাই যেখানে পরিলক্ষিত হচ্ছেনা, সেখানে নীতি নৈতিকতা সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী কেমনে আশা করা যায় ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা একটি সেমিনারে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তির পর ভর্তি কমিটির মূল্যায়নের ভিত্তিতে সবচেয়ে মেধাবী, চারিত্রিক গুণাবলীতে কষ্ঠিপাথরে ঘষা মাঝা করে দেখা হত তার বংশমর্যাদা, পারিবারিক ঐতিহ্য ইত্যাদিতে কোন খারাপ কিছু আছে কি না, এসব যাচাই বাছাই করে ভি.পি পদে মনোনয়ন দেওয়া হত। তখন এ সব ছাত্রকে যেহেতু পূর্বেই মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক যথার্থ বলিয়া সনদ দেওয়া হইয়াছে, সেহেতু সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ন্যাচারেলি শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে মূল্যায়ন পেতেন। তখন তাদের কোন দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মূল্যায়ণ করা হতনা। কিন্তু এখন ! দূরবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খোঁেজ দেখতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে শিক্ষক নিয়োগের সময় তার দলীয় পরিচয় বা অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আদর্শহীন শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেনা। এসব আদর্শহীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পর, তাদের নিজেদের রক্ষার জন্য বিশেষ গুন্ডাবাহিনীর দরকার। দলকানা শিক্ষকরা দলীয় গুন্ডাবাহিনী লালন, চাঁদাবাজি, মাস্তান, চরিত্রহীন, ধর্ষক এসব গুণাবলী সম্পূর্ণ ছাত্রদের সাথে আতাত করে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে, শিক্ষক এবং ছাত্র একে অপরের পরিপূরক হিসাবে ভাগ বাটোয়ারায় লিপ্ত হয়ে শিক্ষাঙ্গঁনকে কুলষিত করে থাকেন। উপেক্ষিত হন সাধারণ ছাত্ররা। প্রকৃত মেধাবী শিক্ষকরা যেহেতু নিয়োগই পাচ্ছে না, সেহেতু পবিত্র বিদ্যাপিঠ থেকে আদর্শ ছাত্র, আদর্শকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্র থাকেনা সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে। তারা পদে পদে উপেক্ষিত, ধর্ষক কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছেন এ কারণে।

এরপরও তো কি আদর্শ বিলীন হতে দেওয়া যায় ? এরপর ও তো কিছু আদর্শ শিক্ষক আছেন যাদের দ্বারা ছাত্রদের গৌরব উজ্জল ঐতিহ্যকে লালন পালনের জন্য কতিপয় প্রস্তাবনা তুলে ধরছি।

যেমন:
(ক) ধর্ষক যে দলেরই হোক না কেন সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা এদেরকে শিক্ষাঙ্গন থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে বহিস্কার করাতে হবে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক। কারণ যখনই বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাজ বা সর্বত্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায়, তখন আর ধর্ষকের পক্ষে কথা বলার লোক পাওয়া যায় না। কারণ দলীয় কর্তৃপক্ষে লোক লজ্জার ভয়ে তাকে আর কোন আশ্রয় প্রশ্রয় দেয় না। বরং অস্বীকার করা হয়, সে আমাদের দলের কেহ নহে? যেমনটি বর্তমান ছাত্র জনতা দেখিয়ে দিচ্ছে আন্দোলন কত প্রকার ও কি কি ? দল তো আর তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।

(খ) বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন: সিনেট, প্রক্টরিয়াল কমিটি বা শৃংখলা কমিটি চাইলে ছাত্র কোন অনৈতিক কাজ যেমন: ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদির সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে। এ সব কমিটি নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে যখনই নিশ্চিত হবে যে অভিয্ক্তু ছাত্র অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কলংকিত করছে, তখনই তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কার করে যথাযথ বিচারিক আদালতে তাকে সোপর্দ করতে হবে এবং বিচারকের কাছে সুপারিশ থাকতে হবে এ সব অপরাধের যে দন্ড দেওয়ার বিধান আছে তা নিশ্চিত করতে হবে বিচারককে। এসব দাগী ক্রিমিনালদের কখনও জামিন দেওয়া যাবেনা। কারণ জামিনে বাহির হয়ে জামিনের অপব্যবহার করে থাকে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে থাকে স্বাক্ষীদের। অনেক ক্ষেত্রে স্বাক্ষী কথা না শুনলে হত্যা করে থাকে।

(গ) আগেকার সমাজ ব্যবস্থা এনালগ বা সনাতনি পদ্ধতি। এখন প্রযুক্তির ব্যবহার ঘরে ঘরে চালু হয়ে গেছে। ডিজিটাল পদ্ধতি বা আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে এবং নতুন নতুন কলা-কৌশলের মাধ্যমে দাগী ক্রিমিনালদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সহজ হচ্ছে। সুতরাং সনাতনী আইনের ধারা অনেক ক্ষেত্রে সংশোধন করে সংক্ষিপ্ত সময়ে এসব ক্রিমিনালদের বিচারকাজ নিষ্পত্তির জন্য বিচারককে ক্ষমতা দেওয়া । যেমন: সাহেদ, সাবরিনা এনু রুপম, আবরার হত্যা, নুসরাত হত্যা মামলা, যে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবে ধর্ষণ মামলার আসামীদের বিচারকার্য সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ করে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করলেই বর্তমান ভেঙে পড়া আইনি ব্যবস্থা তার অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া সম্ভব। যেমন ধর্ষণের ধারা ৩৭৬ এবং শাস্তি মাত্র দশ বা বিচারক চাইলে কম বেশী করতে পারেন। কিন্তু ধর্ষণের মহামারি কালে এ ধারায় প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এখন সময়ের দাবী ধর্ষণের শাস্তি দন্ড বিধি ৩০২ ধারায় বা ক্যাপিটাল পানিশম্যান্ট দ্রুততম সময়ে কার্যকরীর ব্যবস্থা করা।

(ঘ) ধর্ষক কর্তৃক ধর্ষিতার সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই অস্ত্র আইনের সংশোধন একান্ত আবশ্যক। অস্ত্র কোন ধরণের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে, সনাতনি পদ্ধতির সে শর্ত শিথিল করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার জন্য অস্ত্র দেওয়া যাইতে পারে এবং ঐ ছাত্রীর নিরাপত্তা মূল্যায়নের জন্য প্রতিমাসে যে কোন মহিলা পুলিশ বরাবরে প্রতিবেদন দিতে বলা। ঐ ছাত্রী কিভাবে কোন পরিবেশে ঐ অস্ত্র ব্যবহার করবে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। তবেই ধর্ষক ভয়ে ধর্ষিতাকে স্পর্শ করার সাহস পাবেনা। ছাত্রত্ব শেষ হলে কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র ফিরত দিতে হবে।

(ঙ) ছাত্রী বা অন্য যে কোন পেশার মেয়েরা যথাযথ কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্র নিতে পারবে। যেসব বখাটে বিভিন্ন সময় ইভটিজিং বা মানহাকির আচরণ করে তা কিন্তু ছাত্রীকে বা তার অভিভাবককে একাধিকবার কর্তৃপক্ষের নজরে দিতে হবে। যদি কর্তৃপক্ষ ধর্ষককে সংশোধনের আহবান জানানোর পরও সংশোধন না হয়, তাহলে অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার পাবে স্বাভাবিকভাবে ভিকটিম। প্রয়োজনে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করে হলেও ধর্ষিতা তার সম্ভ্রমহানী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে কোন আইনের মারপেচ যাতে না পড়তে হয়, তা সহজীকরণ করা। সুতরাং সরকার চাইলে আইনের সংশোধনী এনে অস্ত্র ও ধর্ষণ আইন যুগোপযোগী করতে পারে।

লেখকঃ এডভোকেট মোঃ আমান উদ্দিন, সভাপতি-সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-বিয়ানীবাজার, সিলেট।