সুইডেন কেন মানবিক দেশ

নাজমুন নাহার নাজমুন নাহার

বাংলাদেশি পতাকাকন্যা

প্রকাশিত: ২:০৯ অপরাহ্ণ, জুন ৭, ২০২০ 754 views
শেয়ার করুন

৬ জুন সুইডেনের জাতীয় দিবস। জন্মভূমি বাংলাদেশের মতো আমার নিজেকে তৈরি করার ভূমি সুইডেকেনও আমি অনেক ভালবেসে ফেলেছি। বাংলাদেশ আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা, কিন্তু সুইডেন আমার সেই জীবনকে অলংকৃত করেছে।

এ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়া পড়াশোনা করার সুবাদে এদেশের মাটিতে প্রথম আমার পদার্পণ। জীবনকে আমি খুব কাছ থেকে দেখা এবং নিজেকে তৈরী করে পরিপূর্ণ হয়ে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছি দ্রুতগতিতে এদেশের মাটি থেকে। দিনে-রাতে নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করা, কাজ করা, পরিশ্রম করে উপার্জন করা এবং একটা সুস্থ পরিবেশে নিজের মেধা ও মনকে বিকশিত করার সুযোগ হয়েছে এখানে আমার।

  • সেই থেকে আজ অব্দি প্রায় ১৩ বছর কেটে গেলো।এর মাঝে আমি পৃথিবীর পথে পথে থাকলেও জীবনের অনেক মূল্যবান সময় আমি কাটিয়েছি এই দেশের আলো বাতাসে। আজকের আমি যে পরিপূর্ণ নাজমুন বাংলাদেশের পতাকা হাতে পৃথিবীর ১৪০ দেশ ভ্রমণ করতে পেরেছি তার পিছনে এদেশের ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যেমন আমার হৃদয়ের একপাশে জুড়ে থাকে ঠিক একইভাবে সুইডেন আমার হৃদয়ের আরেক পাশ জুড়ে আছে। সুইডিশরা যেকোনো ক্রিয়েটিভ ভিন্ন কিছু করে এমন মানুষকে তারা খুবই পছন্দ করে। ২০১৯ এ সুইডেনের পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম হয়েছিল আমার বিশ্বভ্রমন অভিযাত্রা।

এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে দিবসটি খুব ঘন ঘটা করে উদযাপন না হলেও, প্রতি বছরই এই দিনটি থাকে উৎসবমুখর। এদিনে সুইডেনের রাজপরিবারের সকল সদস্যরা বের হয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে।

এ দিনটি সুইডিশ পতাকা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৯১৬ সাল থেকে রাজা গুস্তাভ ভাসার সম্মানে উদযাপিত হয়ে আসছে, যিনি ১৫৩৩ সালে এই দিনে মুকুট অর্জন করেছিলেন, এবং সুইডিশ সংবিধান যা ১৯০৯ সালে এই দিনে গৃহীত হয়েছিল।

এদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি এদেরকে উন্নত একটি জাতিতে নিয়ে এসেছে। পৃথিবীর বুকে সুইডিশরা আজ মানবিক জাতি হিসেবে পরিচিত। আমার সুইডিশ জীবনের বহু বছর কেটে গেল। আমি যখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াই, কিন্তু ক্লান্ত হলে ফিরে যেতে চাই সুইডেন কিংবা বাংলাদেশ। তাই নিজের দেশের মতো এই দেশটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।

সুইডেনের বিশেষ কিছু মানবিক বিষয় আমার হৃদয়ে অনেক বড় জায়গা করে নিয়েছে। সুইডেনে আসার পর আমি আমার জীবনের অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পেরেছি। আমার স্বপ্নগুলোকে আমি ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত করতে পেরেছি।

এখানে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নির্ণয় হয় না, যেখানে সাদা- কালো বর্ণ বিভেদের রেষারেষি নেই। এখানে মানুষ যার যার ধর্ম খুব শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পারে। ছোট-বড়, কানা, বধির, ট্রান্সজেন্ডার, ভিন্ন জাতি, ধনী-গরীব সবাই একই নাগরিক সুবিধা পায়। এসব মানবিক বিষয়ের কারণে সুইডিশরা আজ উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করতে শেখা এবং বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা স্কুল থেকেই সে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয় এই সমাজ।

সুইডেনে আসার পর কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ক্যাম্পাস লাইব্রেরী থেকে অনেক রাতে পড়াশোনা শেষে, কিংবা প্রফেসরের সাথে মিটিং শেষে বাসায় ফিরেছি কখনো হেঁটে কখনো সাইকেল চালিয়ে কিংবা কখনো বাসে করে। কখনো বরফখন্ডের উপর দিয়ে জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে রাতে বিরাতে হেঁটেছি।‌ কোন সমস্যা হয়নি এখন পর্যন্ত।

আমার নিজের মোবাইল দু’বার হারিয়েছে, দু’বারই ফেরত পেয়েছি। আমি নিজেই তিনবার টাকা মোবাইল সহ মূল্যবান জিনিসপত্র পেয়েছি পথে হাঁটতে হাঁটতে, সেই মানুষদের খুঁজে বের করে আবার তাদের জিনিস ফেরত দিয়েছি। এমন একজন সুইডিশ ভদ্রমহিলা মারিতা, তার মোবাইল, ভিসা কার্ড (কোডসহ), টাকা ২০১৪ সালে আমি পেয়েছি বরফঢাকা এই শহরের পথের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে। তাকে সেগুলো ফেরত দিয়েছি। মারিতা আমার সততার মূল্যায়ন করেছেন আমাকে অনেক বড় এক উপহার দিয়ে। সুইডেনের খবরের পাতা জুড়ে এসেছিল সেই মূল্যবান ঘটনা। তিনি আমাকে তার সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সেটা ছিল আমার জীবনের আরেকটি বিরল পাওয়া।

রাস্তায় চলার সময় যখন কেউ রাস্তা চিনে না কিংবা ভুলে যায় কিংবা পথ হারিয়ে ফেলে এখানকার মানুষ পারলে তাকে বাসা দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কোন কিছু না বুঝে তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বুঝিয়ে দেয়। কাস্টমার সার্ভিস কারো সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না।

অফিস-আদালতে প্রথম কেউ চাকরিতে ঢুকলে সিগনেচার দিতে হয় একটা কন্টাক্ট পেপারে যার সাথে একটি অনুচ্ছেদ লেখা থাকে যেখানে ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড়, ট্রান্সজেন্ডার, যে কোনো মানুষই হোক না কেন ওই অফিসের সবাইকে যেন একই দৃষ্টিতে সম্মান করতে হবে।

শিশুদেরকে এখানে ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতে শেখায়। প্রথমেই নৈতিক মূল্যবোধ এবং নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে শেখানো হয় স্কুলগুলোতে।

মানুষের জীবনের স্বাধীনতার অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় এখানে। কেউ কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। এখানে মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা বিরাজমান। কেউ বোরকা পরে হাঁটলেও কেউ কাউকে টিজ করেনা, আবার কেউ যদি হাফপ্যান্ট পরেও হাঁটে সেখানেও কেউ কোনো কিছু বলে না। সবাই যে যার ধর্ম, যে যার কাজ শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে।

রাস্তায় হাঁটার সময় কেউ কাউকে কটাক্ষ করে কথা বলে না। রাস্তা পার হওয়ার সময় মানুষ দেখলে গাড়ির ড্রাইভার অনেক দূর থেকেই থেমে যায়। শুধু মানুষ নয়, রাস্তা দিয়ে কোন পশু হেঁটে গেলেও ড্রাইভার নিজ দায়িত্বে থেমে যায়। মানুষ জেব্রা ক্রস অনুসরণ করে হাঁটে।

বস এবং কর্মচারীদের মধ্যে ভয়ঙ্কর কোনো দূরত্ব নেই। প্রয়োজনে বস কাজের করার জন্য নিজের চেয়ার ছেড়ে তার অধীনস্থ কলিগকে বসিয়ে দেয় কাজ করার জন্য। মানুষ ভীষণ পরিচ্ছন্ন। মানুষ নির্দিষ্ট জায়গা ময়লা ফেলে। সবাই সবার বাসাবাড়ি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন করে রাখে। বাড়ির আশেপাশে যে ফুল বাগান সেটাকে যত্ন করে রাখে। সবাই এখানে নিজের কাজ নিজেই করে। ছোট বড় যেকোনো কাজকে মূল্যায়ন করা হয়।

এখানে শিশুদের সাথে কথা বলার সময় নিচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে অনেকে কথা বলে। শিশু আইন খুবই কঠিন। শিশুদের গায়ে হাত দেওয়া হারাম। কেউ কাউকে মারতে পারবে না। শুধু তাই নয়, স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো গায়ে হাত দিলে তার জেলসহ অনেক টাকা জরিমানা হয়।

এখানকার মানুষ খুবই প্রকৃতিপ্রেমী। বাইরে প্রকৃতির মধ্যে বসে বই পড়া, কোন লেকের পাড়ে, সমুদ্রের পাড়ে কিংবা পাহাড়ের কোলে হয়তো একটা মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকা খুব পছন্দ করে।

সুইডেন কোন দেশের অধীনস্থ নয়, আবার সুইডেন কাউকে তাদের অধীনস্থ করেও রাখেও না। সবার সাথে তাদের খুব ভালো সম্পর্ক মানবিক গুণাবলীর কারণে।

এখানকার মানুষ কমিটেড। কথা দিলে কথা রাখে। সময়ের কাজ সময়ে করে। দশটা মানে দশটা। কেউ যদি কোন কারণে সময়মতো উপস্থিত হতে না পারে তাকে অবশ্যই ফোনে কিংবা মেসেজ দিয়ে পূর্বে জানিয়ে দিতে হয়।

এখানে প্রতিটি শহর এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসের জন্য বিখ্যাত। পুরো দেশটি বিকেন্দ্রীকরণ নগরায়ন। রাজধানী স্টকহোমে সবকিছুর জন্য বিখ্যাত নয়।

এখানে ফিকা কালচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুরা সবাই মিলে বসে কফি পান করা সেই কালচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ দেশের মানুষ ফুটবল খেলা খুব ভালোবাসে। এরা খুবই ফ্যাশন সচেতন, গান প্রিয়, প্রকৃতি প্রিয় মানুষ এরা।

সুইডেনের উত্তরের শহর কিরুনার আইস হোটেল, আবিষ্কো নর্দান লাইট, নর্থপোলের মধ্য রাতের সূর্য, পৃথিবীর আর্টিক সার্কেল, স্টকহোমের ওয়াকিং স্ট্রিট, নোবেল মিউজিয়াম, ভাসা মিউজিয়াম, কোথাও কোথাও হাজার বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিয়ের জন্য বিখ্যাত।

জাতীয় দিবসে এখানকার সবাই পালন করে তাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য। এইদিনে সুইডেনের নতুন নাগরিকদেরকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়। পড়াশোনা শেষ করার পর এদেশে চার বছর কাজ করার জন্য সুইডিশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি আমাকে তাদের গর্বিত সুইডেনের নাগরিক বানিয়েছে।

জীবনের সমতা, সততা, পরিছন্নতা, পরিশ্রমের মাধ্যমেই এখানে মানুষ আজ এতদূর এগিয়েছে।

লেখক: নাজমুন নাহার, বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক