
‘আল্লাহ্ বলো মনরে ভবে কেউ কারো নয় দুঃখের দুখী’। ভাব তরঙ্গে ডুব দিয়ে চোখ বন্ধ করে এভাবেই গেয়ে উঠলেন বাউল আনোয়ার রেজা। যেনো সাঁইজি একদম সামনে উপস্থিত। অনানুষ্ঠানিক আয়োজন আর শান্তিগঞ্জ শহিদ মিনারের পাদদেশে বসে গান যেনো সবাইকে শীতল করে তুলেছে। একটি করে গান। সময়ের স্বল্পতা। মাগরিবের আগে এ আয়োজন শেষ করার ইচ্ছা আমাদের। শাহজালাল মহাবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল কবির ‘স্মরনাসরের’ মধ্যমণি। বাউল লাল শাহ এ আয়োজনে খুবই কষ্ট করেছেন। আয়োজন তেমন কিছুই না। সাঁইজির ছবি সংম্বলিত একটি ব্যানার, সাউন্ড বক্স আর যৎসামান্য বাদ্যযন্ত্র। বাউল লাল শাহ না থাকলে আয়োজনটা হতো কি না সন্দেহ ছিলো। আসর উপস্থাপনার মাঝখানে তিনিও গেয়ে উঠলেন-
‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি,
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।’
শনিবার বিকালটা যেনো ঝিম ধরে গিয়েছিলো শান্তিগঞ্জের শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে। চারদিকে মানুষ জড়ো হতে থাকে। আমাদের আসরও জমে উঠে। লালন শাহ আমাদের মাঝে আরো প্রাণবন্থ হয়ে উঠেন ক্রমাগত। খুব বেশি সময় পাইনি আমরা। বিকাল ৪টায় শুরু হওয়া প্রোগ্রাম শেষ করতে হয়েছে ৫টা বাজার পর পর। ইচ্ছে ছিলো লম্বা করার কিন্তু আলো কোথায় পাবো? অন্ধকার যে!
বাউল রেদুয়ান খান গাইলেন সাঁইজির পদ। ‘করি মানা কাম সাড়ে না মদনে, প্রেম রসিকা হবো কেমনে’। এম এ ওয়াদুদ তাঁর ভরাট কণ্ঠে গাইলেন, ‘এসব দেখি কানার হাঁটি বাজার।’ লালন শাহ দিনের আলোতে বাজারে বাজারে বেশির ভাগ সময় অন্ধদের দেখেছেন। তাই হয়তো তিনি তাঁর লেখায় অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করেছেন। কিন্তু সমকালীন প্রশ্ন হচ্ছে- এ আয়না কিনেছেন কয়জন?
এমন আয়োজনে আমাদের অনুষ্ঠান খুব তারাতাড়ি শেষ হয়েছে। কিন্তু এর রেশ রয়েছে। থাকবেও। খুব শিগরির অন্য কোনো আয়োজনে বাউলরা, বাউলভাবী মানুষেরা তাঁদের ভাবের উদ্রেক অন্য কোনোখানে প্রকাশ করবেন।
অনুষ্ঠানে শুধু গান হয়নি। এনামুল কবিরের মতো মানুষ যেখানে আছেন সেখানে কিছু সারগর্ভ আলোচনা না হওয়াটা অস্বাভাবিক। আলোচনা হয়েছে। লালনের দর্শন আমাদের মনে আজো দাগ কাটে কিন্তু কেন যেন সে দর্শন আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিফলন ঘটায় না। এ আলোচনা মূখ্য হয়ে উঠে। আমি যখন কথা বলি, তখন নিজেকে মূর্খ মনে হয়েছে। আরো পড়াশুনা করা দরকার। কথা অনেকে বলেছেন, আবদুল মজিদ কলেজের প্রভাষক জাফর মিয়া, কবির আহমদ, উদীচী শান্তিগঞ্জের সভাপতি শ্যামল দেব ও ডুংরিয়া কলেজের প্রভাষক দোলন দেবনাথও কথা বলেছেন। লালন নিয়ে যুগ যুগ ধরে গবেষণা হচ্ছে। আমরা আলোচনা করেছি তা হচ্ছে- সাঁইজিকে স্মরণ করা।
সম্ভু নাথ চন্দ কাকার কথা না বললেই নয়। তিনি এতো সুন্দর বাজিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেন না। তবলা দারুণ বাজান তিনি। গানের গলাও দারুণ। আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন। তিনি তবলা বাজিয়েছেন সমস্ত অনুষ্ঠানে। বাউল শরিফুল ইসলাম বেহালা, ঢপকি বাজিয়েছেন। আরো অনেকে অনেক কিছুই বাজিয়েছেন।
ছোট্ট এ আয়োজনে কবি বোদ্ধ দেব বাপ্পা, সাংবাদিক আবু সাইদ, সংগীত প্রেমী জাহাঙ্গীর আলম, সাগর কৃষ্ণ, আবিদ উদ্দিন, মো. বদরুল আলম, আজিজ রেজা, আবদুর রহমান, ফয়জুর রহমান, মৃদুল দাশ ও আঙুর মিয়াসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজন ছোট ছিলো। কিন্তু এর পরিধি ছিলো বিশাল। এখান থেকে একটি সত্য উচ্ছারিত হয়েছে, মানববাদী লালনের দর্শন ছড়িয়ে পড়–ক মানুষের মাঝে। যুগে যুগে লালন শাহ যে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন তা সহজেই অনুমেয় হয় শান্তিগঞ্জ শহিদ মিনারের পাদদেশে।