এই মহামারিতে সত্যিকারের মানব হবার সময়

প্রকাশিত: ৪:২৫ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০২০ 666 views
শেয়ার করুন

করোনাভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চীনের হুপেই প্রদেশের উহান নগরীতে প্রথম শনাক্ত করা হয়। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে বিশ্ববাসী করোনা ভাইরাসের সাথে ব‍্যাপক ভাবে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতেই মানুষের মনে ধারণা জন্মেছিল বাদুর বা এই জাতীয় কোনো স্তন‍্যপায়ী পশু / প্রাণীর মাধ্যমে এই রোগের ভাইরাসটি বিস্তার করে। যেহেতু সেটি চীনের ঘটনা আর চীন বাদুর, বানর, সাপ ইত্যাদি খাবারের জন্য প্রসিদ্ধ। আরেকটি ঘটনা চীনে নাকি বিগত দিনে মুসলিম নিধন মানে মুসলমানরা বিভিন্ন নিপীড়ন, নির্যাতন, নিগ্রহ, হত্যা প্রভৃতি উদ্ভূত পরিস্থিতির মাধ্যমে সেখানে দিনানিপাত করছেন। তাই ভাইরাসের খবরটি বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা একটি গজব হিসেবে বিবেচনা করেন। চীন তাদের যে শহর উহানে ভাইরাসটি প্রথম ধরা পরে সেই শহরকে লকডাউন ঘোষণা করে অন‍্যান‍্য শহর বা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সেখানে অবস্থানরত বিভিন্ন বিদেশী বিশেষ করে বাংলাদেশের কয়েকজন সেই সময় ফেসবুক লাইভে এসে ভাইরাসটিকে জনমনে ব‍্যাপক পরিচিত করে আর ‘আমরা বের হতে পারতেছিনা’, ‘ঘরে খাবার নাই’, ‘দোকান গুলো সব বন্ধ’ এসব বলে ভাইরাল হয়। মানুষ জন তখন বিষয়টি ততটা গুরুত্ব দেয় নাই, বিনোদন হিসেবেই নিয়েছে। কিন্তু টনক নড়ে কিছু দিন পর থেকে। নতুন বছরের শুরু থেকে ভাইরাসটি ধীরে ধীরে চীনের মূল ভূখণ্ডের অন্যান্য প্রদেশ এবং বহির্গামী বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সহ অন্যান্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।

  • বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ব্যাখ্যা করা হলেও এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবকে ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২৩ মার্চ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ‘ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন ‘ এই স্লোগানটি সামনে রেখে তিন সপ্তাহের লক ডাউন ঘোষণা দেন। ইতিমধ্যে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ব‍্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইটালি, ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন‍্যান‍্য অনেক দেশ নিজেদের লক ডাউন ঘোষনা দেয়। ব্রিটেন শুরুতেই ফ্রন্ট লাইন কর্মজীবী ডাক্তার, নার্স, ফায়ার কর্মী ছাড়া বাকি সকলকে ঘরে থেকে কর্ম সম্পাদন করা এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব‍‍্য সামগ্রীর দোকান ও ফার্মেসী ছাড়া অন্য দোকান পাট বন্ধের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে রেষ্টুরেন্ট গুলোতে শুধুমাত্র টেইক ওয়ে সার্ভিস চালু রাখার নিয়ম করে দেয় যদিও ফাস্ট ফুডের কিছু ব্রান্ডেড দোকান যেমন ম‍্যাকডোনাল্ড, কেএফসি, জন লুইস সহ অন্য আরও কিছু দোকান নিজেদের পুরোপুরি বন্ধ ঘোষনা করে। লকডাউন ঘোষণার শুরুতে ব্রিটেনে ক্রেতাদের মধ্যে কেনাকাটার ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ফলশ্রূতিতে এশিয়ান ও অন‍্যান‍্য কিছু দোকান গুলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের মূল্যবৃদ্ধি করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার ধান্দায় মেতে ওঠে। মার্কেট থেকে হ‍্যান্ড স‍্যানিটাইজার, টয়লেট টিস্যু, চাল, ডাল, ডিম প্রভৃতি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। কিন্তু অল্প সময়েই আবার মার্কটে স্থিতিশীলতা চলে আসে।

  • এই করোনার মাঝেও এক জন ব্রিটেনের মিডিয়ায় আলোচনার জন্ম দেন, তিনি ক্যাপ্টেন টম মুর। মূলত তাঁর ১০০ তম জন্মদিনের আগে বাগানের উঠানে ১০০ টি বার পা ফেলে পদক্ষীন করে এনএইচএস দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য মাত্র ১০০ পাউন্ড সংগ্রহের লক্ষ্যে নেমেছিলেন। সেই ৯৯ বছর বয়সী যুদ্ধা তিনি শেষ পযর্ন্ত প্রায় ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ডের অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং তাঁকে ডিউক অফ কেমব্রিজ দ্বারা “এক ব্যক্তির তহবিল সংগ্রহকারী মেশিন” হিসাবে প্রশংসিত করা হয়েছে। ব্রিটেনের রাণী ও প্রধানমন্ত্রী টম মুর’কে বিশেষ শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন।

২৩ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে ভ্যাকসিন পরীক্ষায় এলিসা গ্রানাতো নামের মহিলা বিজ্ঞানী’কে মানব দেহে প্রথম রোগীর ইনজেকশন দেয়া হয়। এই দিন দু’জন স্বেচ্ছাসেবককে ইনজেকশন দেওয়া হয়, ৮০০ এরও বেশি লোক এই গবেষণার জন্য নিবন্ধন করা হয়। এই ভ‍্যাকসিন গবেষণা যদিও বা সফল হয়, তবুও আগামী দুই মাস লেগে যাবে ইনজেকশন ব‍্যবহার উপযোগি করতে।

মানব জাতি বিগত শতাব্দী গুলোতেও অনেক বার মহামারির সম্মুখীন হয়েছিল এবং সেখান থেকে উত্তোরণও ঘটে। সাধারণত মহামারীর সমাপ্তি ঘটে দুটি প্রক্রিয়ায়, প্রথমত চিকিৎসার মাধ্যমে অর্থাৎ একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা দুটোই কমিয়ে নিয়ে আসা। আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক সমাপ্তি। রোগটি নিয়ে মানুষের মাঝে যে ভয় বিরাজ করে সেটি যদি উধাও হয়ে যায় তাহলে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, আর রোগটিও প্রকৃতিগতভাবেই তার কার্যকারীতা হারায়। এখন দেখার বিষয় বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগের মহামারি করোনাভাইরাস কোন প্রক্রিয়ায় তার বিলুপ্তি ঘটে।