মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য ও পরিণাম

প্রকাশিত: ৩:৩৭ অপরাহ্ণ, মে ৪, ২০২০ 799 views
শেয়ার করুন

মুনাফিক একটি নিকৃষ্ট চরিত্রের নাম। আমাদের সমাজে কিছু মুসলমান রয়েছে যারা নামে ইসলামকে ব্যবহার করে কিন্তু কাজে নয়। হজরত রাসূলুল্লাহ সা:-এর আমলেও এ ধরনের মুসলমান ছিল। তাদের কারণে তখনো মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল। মুনাফিক অর্থ হলো কথায় এবং কাজে দ্বিমুখী আচরণ করা। মুখে এক রকম এবং কাজে আরেক রকম ভাব পোষণ করা। মুনাফিকেরা মানুষের সামনে এক ধরনের এবং পেছনে আরেক ধরনের আচরণ করে থাকে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘চারটি স্বভাব এমন যার সবগুলো কারো মধ্যে থাকলে সে পুরোদস্তুর মুনাফিক, আর যার মধ্যে তার কোনো একটি থাকবে, সে যতক্ষণ তা পরিত্যাগ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকির একটি স্বভাবই থাকবে। স্বভাব চারটি হচ্ছে- যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় সে তাতে খিয়ানত করে, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন কোনো ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং যখন কারো সাথে ঝগড়া করে গালাগালি করে’ (বুখারি ও মুসলিম)।

আমানতের খিয়ানতে ইহ ও পরকালীন অকল্যাণ : কারো কাছে কোনো অর্থসম্পদ গচ্ছিত রাখার নাম আমানত। যিনি গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন এবং এর প্রকৃত মালিক চাওয়া মাত্র তা অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন, তিনি আমানতদার। আর গচ্ছিত সম্পদ যথাযথভাবে মালিকের কাছে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করা আমানতের খিয়ানত।
অনেকে শুধু টাকাপয়সা গচ্ছিত রাখাকেই আমানত ভাবেন। কিন্তু আমানতের গণ্ডি এত সীমিত নয়, বরং এর পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সাথে আমানত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সমাজের প্রত্যেকেই একেকজন আমানতদার। রাষ্ট্র পরিচালনা, ভোট প্রদান, সাংবাদিকতা, অফিসিয়াল কাজকর্ম, শিক্ষকতা, ব্যবসায় বাণিজ্য, শ্রম-মজুরি সবই আমানত। এগুলো যথাযথভাবে পালন না করা খিয়ানতের অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ইসলামী জীবনপদ্ধতির সব করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের সাথে আমানতদারির সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি প্রত্যেক মানুষের শরীর ও প্রাণ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে আমানত।

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আমানত রক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত তার মালিককে ফেরত দেবে’ (সূরা নিসা, আয়াত-৫৮)। আমানতদারির পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আমানত রক্ষা করে তারা ফেরদাউস নামক জান্নাতের অধিকারী হবে, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত-১১)।

আমানতের খিয়ানত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, সে মুমিন মুসলমান নয়।’ তিনি আমানতের খিয়ানতকারীকে মুনাফিক আখ্যা দিয়েছেন। প্রচুর পরিমাণ নেক আমল করার পরও আমানতের খিয়ানতকারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। হাশরের মাঠে আল্লাহ তাকে আমানতকারীর আমানত আদায়ের জন্য বলবেন। তখন আমানত পরিশোধ করতে না পারার দরুন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
ফেরেশতা এবং সব নবী-রাসূল ছিলেন আমানতদার। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন আমানতদারির মূর্তপ্রতীক। চরম শত্রুরাও তাঁর কাছে সম্পদ আমানত রাখত। সে জন্য তৎকালীন নীতিহীন বিশ্বে তিনি ‘আল-আমিন’ বা ‘পরম বিশ্বস্ত’ উপাধি লাভ করেছিলেন। আমানতদার ব্যক্তি সমাজের সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও সম্মানিত। আমানতদারি এমন এক মহৎ গুণ, যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।

আমানত রক্ষার ওপর নির্ভর করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি। আর কোনো দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক নৈরাজ্য ও দেউলিয়াপনা সৃষ্টি হয় আমানতদারির অভাবে।
ওয়াদা ভঙ্গকারীর কোনো ধর্মই নেই : ওয়াদা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় কারো সাথে কেউ কোনো অঙ্গীকার করলে, কাউকে কোনো কথা দিলে বা লিখিত চুক্তি করলে তা পালন করার নাম ওয়াদা। যাপিত জীবনে মানুষ মানুষের সাথে বিভিন্ন রকম ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এই ওয়াদা পালন করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অঙ্গ। সংসার ও সমাজ জীবনে ওয়াদা রক্ষাকারীরা মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য। সবাই ওয়াদা পালনকারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন। ওয়াদা রক্ষা করা আল্লাহর একটা গুণও বটে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পৃথিবীতে ওয়াদা পালনের এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। যেকোনো ধর্মে ওয়াদা পালনের গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামে ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তাদের জন্য পরকালে রয়েছে কঠোর শাস্তি। ওয়াদা ভঙ্গ করা মারাত্মক অপরাধ। ওয়াদা পালনের প্রতি জোরালো তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তোমরা ওয়াদা পালন করবে, ওয়াদা সম্পর্কে তোমাদের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৪)।

ঝগড়া-বিবাদে গালাগালি করা নিকৃষ্ট স্বভাব : মূলত মুনাফিক ব্যক্তিই অন্যের সাথে কলহ-বিবাদে লিপ্ত হলে মুখ খারাপ করে এবং অবলীলায় অশ্রাব্য গালমন্দ শুরু করে দেয়। যাপিত জীবনে কত রকম মানুষের সাথেই মেলামেশা ও লেনদেন করতে হয়। এতে কখনো কখনো মতের অমিল দেখা দেয় এবং মাঝে মধ্যে তা কলহ-বিবাদ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু একজন প্রকৃত মুমিন কোনো অবস্থাতেই মুখ খারাপ করতে পারে না। সব সময় সে নিজ ভদ্রতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ব্যাপারে সচেতন থাকবে। দৃষ্টিভঙ্গিগত মতভেদ হোক, চিন্তা-চেতনার অমিল হোক, রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়িক বিরোধ হোক, কোনো অবস্থাতেই একজন মুমিন তার মুখ দিয়ে মন্দ বাক্য উচ্চারণ করবে না। হাদিসের দৃষ্টিতে এরূপ করা মুনাফিকের আলামত।