আমার বাবা সাধারণ মানুষ কিন্তু অসাধারণ পিতা

লুৎফুর রহমান লুৎফুর রহমান

সম্পাদক ও সিইও, বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ৯:০৯ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১ 722 views
শেয়ার করুন

আমার বাবাকে আমরা ‘আব্বা’ ডাকতাম। আমরা ৩ ভাই, ২ বোন। আমি সবার বড়। তাই আনুপাতিক হারে সবার চেয়ে বেশি স্নেহ ভালবাসা আমি পেয়েছি। আর পেয়েছে সাইদুর মাহমুদ ছোট হিসেবে। যদিও মা বাবার কাছে ১০ টা সন্তান হলেও সবার ভালবাসা সমান। তবুও প্রথম আর শেষজনে দূর্বলতা থাকে। আব্বা আমাকে খুব ভালবাসতেন। জীবনে মাত্র একদিন একটি থাপ্পড় মেরেছেন আমাকে। বাকি পুরো জীবনে দিয়েছেন ভালবাসা, শিক্ষা আর মমতা। আমি যখন স্লেটে কয়েকবার উলটা ‘ক’ লিখছিলাম আব্বা এই প্রথম একটি থাপ্পড় দিয়েছিলেন। সেইদিন থেকে ‘ক’ সোজা করে শুধু লিখি নাই বরং হাতের লেখা সুন্দর সেদিন থেকেই হয়েছে।

আব্বা পুকুরে সাঁতার শিখিয়েছিলেন যখন কী না ভয় করত আমার ভাবতাম এই ডুবে যাব। কিন্তু বাবার মুখের হাসি যেন এটা বুঝাচ্ছিল দুনিয়াতে ভূমিকম্প হলেও নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচাব। জী সেটাই। দুবাই এসে এখানকার গরম দেখে এখন ভাবি কতো গরমে ত্যাগ করে আমাদের মানুষ করতে বাবা কাজ করেছেন। আব্বার বড় শখ ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবেন। এস এস সি আর এইচ এস সি তাই সাইন্সে পড়াইছিলেনও। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমি লেখালেখি আর সামাজিক কাজে আগ্রহি ছিলাম। এসব নিয়ে শুরুর দিকে আব্বা আম্মাকে শুনাতেন ঠিক ই কিন্তু একসময়ে ‘আমি লুৎফুরের আব্বা’ পরিচয় যখন দিতেন সন্তান হিসেবে আমাকে ধন্য লাগত।

প্রতিটি পরিবার আসল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একদিন বাইরে থেকে আমাদের ঘরের কলিংবেলে কেউ একজন রিং দিলেন। আমি ‘কেগুবে’ বলে বিরক্ত হয়ে দরজা খুললাম। অইপাশে ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আব্বা সেদিন আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন ‘কে’ শব্দ বলতি। এতে ছোট হলেও চলে বড় হলেও চলে। সেদিন থেকে এটা মনে গাঁথি। এছাড়া আব্বা প্রতিদিন বাজার শেষে বাড়ি এসে হিসাব কষতেন। ২ টাকার অমিল হলে টেনশন করতেন। আমরা হাসতাম বলতাম নিজের টাকা বেশ কম হলেই বা কী। তিনি বলতেন অমিল মানে আমার কোথাও কেউ বেশি নিছে অথবা আমি কাউকে কম দিয়েছি। দুটাই অন্যায়। হিসেবি বাপের বেহিসেবি পোলা তিনার মতো হিসাব না জানলেও সততা আর নীতি ধরে রাখতে শিখেছি।

আমি যখন ছোট ছিলাম আব্বা বলতেন ‘কিতা আনতাম’? বলতাম ‘কিতাই আনিও’। তখন থেকে এখন পর্যন্ত অনেকে আমাকে ‘কিতাই’ বলে জ্বালাতন করে।
আব্বা খুব সহজ মানুষ ছিলেন। তবে সুন্দর মন আর সুন্দর জীবনের অধিকারি। ত্যাগ করা আর সহজে মনের কথা বলে ফেলার অভ্যাস ছিল। যার কিছুটা আমাতে আছে। তিনি বেহালা বাজাতেন। শাহ করিমের গানে ঘুম পাড়াতেন আমাকে। অবশ্য সংসার বাড়ার সাথে সাথে সেই চর্চা শেষ হয় একদিন। তবে আমরা ভাই বোনেরা ঘরে গান করলে মন দিয়ে শুনতেন আর ভুল ধরতেন।

এমন বাবার সন্তান হয়ে আমি গর্বিত। যে কিনা দুর্নীতিবাজ না। রাজাকার না। পরের হক মেরে খাওয়া লোক না। বাবা তুমি আমার শিক্ষক, তুমি আমার প্রেরণা। তিনি যে সংগ্রাম করেছেন সারাজীবন নিজের পরিবারের জন্য কারণ তিনি অল্প বয়সে এতিম হয়েছিলেন। তাই ভাই বোনদের মানুষ করার জন্য সংগ্রাম করেছেন। ২০১৬ সালে আব্বাও চলে গেলেন খোদার ডাকে। তাঁর সেই সংগ্রামি জীবনে এবার বড় ছেলে হিসেবে আমার যাত্রা। আব্বা, তোমার রেখে যাওয়া দায়িত্ব যেন পালন করতে পারি। ডাক্তার না-ই হই অমানুষ যেন না হই নিজেকে প্রতিদিন এই প্রতিজ্ঞায় রাখি। আমার প্রতিটি ভালকাজে তোমার সফলতা আব্বা। যখন বিপদে পড়ি অথবা সংকট আসে আল্লাহ পার করে দেন সহজে আমি বিশ্বাস করি আমার মা বাবার দোয়াই আমার বড় সম্বল। আর প্রতি মন্দ কাজের জন্য বিফলতা আমার। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।