সবিরনিা আর আরিফ নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া

লুৎফুর রহমান লুৎফুর রহমান

সম্পাদক ও সিইও, বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ৩:১৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২০ 450 views
শেয়ার করুন

‘সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করলেও তা ড্রেনে ফেলে দিতেন অপনারা। করোনা পরীক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাঁচ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন অপনারা। আর বিদেশিদের কাছ থেকে পরীক্ষার জন্য নিয়েছেন ১০০ থেকে ৩০০ ডলার। কিন্তু দেশি-বিদেশি কারো নমুনাই পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠাননি। রোগীর লক্ষণ বা চেহারা দেখে অনেকটা আন্দাজ বা অনুমানের ভিত্তিতে ভুয়া সনদ দিতেন। বলুন এসব ঠিক কি না?’ জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদেরাগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তাঁর স্বামী আরিফুল হক চৌধুরী এসব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, সব কিছু স্বীকার করলেও এসব অপকর্মের জন্য তাঁরা পরস্পরকে দোষারোপ করেছেন।

‘সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজির চেয়ারম্যান হয়ে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ভঙ্গ করেছেন আপনি’—সাবরিনা এ অভিযোগও খণ্ডাতে পারেননি।

রিমান্ডে থাকা সাবরিনা ও আরিফকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা। গত বুধবার রাতে ডিবি কার্যালয়ে তাঁদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সরকারের কাছ থেকে বিনা মূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামের দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নেওয়া এবং নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া সনদ জালিয়াতি করার অভিযোগে সাবরিনা ও তাঁর স্বামী আরিফ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, আরিফ ও সাবরিনাকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তাঁরা দুজনই করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।

এসব প্রতারণায় কার কী ভূমিকা ছিল সেটাই এখন তদন্তের মুখ্য বিষয় জানিয়ে ডিবির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের পর প্রথমবারের মতো সাবরিনা ও আরিফকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁদের অপরাধের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। জেকেজি করোনায় টেলিমেডিসিন সেবার নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এখন বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই চলছে।

জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফ হলেও করোনা প্রতারণার নেপথ্যে থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করেছেন সাবরিনা—এ কথা জানিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট ওই ডিবি কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করেও তাঁরা প্রতারণা করেছেন। তাঁদের দুর্নীতির বিষয় জানাজানি হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালককেও দেখে নেওয়ার হুমকি দেন তাঁরা।

তিনি বলেন, করোনা মহামারি নিয়ে পুরো বিশ্ব যেখানে চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে, সেখানে দেশের মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিষয় নিয়ে এমন প্রতারণা কেন করেছেন—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল সাবরিনা ও আরিফকে। তাঁরা দুজনই এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কিছু সময় চুপ করে থাকেন। এ সময় আরিফ বলেন, করোনা জালিয়াতি সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী সাবরিনা সব কিছু জানতেন। তবে আরিফের এ কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন সাবরিনা। তিনি জেকেজির করোনা প্রতারণার জন্য উল্টো আরিফকে দায়ী করেন। তবে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবরিনা প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন নিতেন, এর প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবরিনা জেকেজি থেকে বেতন নিয়েছেন, এমন তিনটি স্লিপ তাঁদের হাতে রয়েছে। ভুয়া করোনা রিপোর্টের বিষয়ে ডা. সাবরিনা বলেন, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কেউ নন। তখন সাবরিনার মোবাইল ফোনের মেসেজ বের করে ডিবি কর্মকর্তারা সাবরিনার সামনে তুলে ধরেন। তখন বিষয়টি স্বীকার করে সাবরিনা বলেন, ওই সব মেসেজ আরিফ তাঁকে পাঠাতে বাধ্য করেছেন।

আরিফ-সাবরিনাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদকারী ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল গতকাল বলেন, ‘গত রাতে তাঁদের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদে এমন অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে কিছু ক্লু নিয়ে কাজ করছি আমরা।’ বাসা থেকে সংগ্রহ করা করোনা পরীক্ষার নমুনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে না পাঠিয়ে বা পরীক্ষা না করেই ফলাফল জানানোর অভিযোগে গত ২৩ জুন জেকেজির সিইও আরিফুলসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় ডা. সাবরিনাকে।