‘দানে দানে পে লেখা হায় খানেওয়ালেকা নাম’

প্রকাশিত: ১২:০৮ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২০ 604 views
শেয়ার করুন

হিন্দি সিনেমার একটা গানের প্রথম কলি খুব মনে ধরেছিলো আমার। সিনেমার নাম বারিস। দেব আনন্দের সুপারহিট সিনেমা। দেব আনন্দেদের লিপে গানের কলিটি ছিলো–দানে দানে পে লেখা হায় খানেওয়ালেকা নাম। অর্থাৎ খাবার দাবারের প্রতিটা দানায় যে খাবে তার নামটি লেখা থাকে। সংলাপটা প্রায়শঃ আমার জীবনে সত্যি হয়ে ধরা দেয়। কখনো কখনো বিপুল আগ্রহে খুব মজা করে খাবো বলে যেটা কিনি দিন শেষে সেটা আর আমার ভাগ্যে জোটে না। কোনো না কোনো কারণে সেটা অন্যের পেটে চালান হয়ে গিয়ে বুড়ো আঙুল দেখায় আমাকে।

২০১০ সালের বইমেলার সময়টায় আমি ছিলাম আহমাদ মাযহারের বাড়িতে। মাযহার থাকে বসুন্ধরায়। এক রাতে ফেরার সময় যথারীতি বসুন্ধরার মোড়ের কাঁচা বাজারে ঢুকলাম আমি আর মাযহার। ঢাকার কাঁচা বাজারে মাছ আর সবজি কেনাটা আমার খুব পছন্দের। কানাডায় যে ফুলকপিটা আমি সাড়ে তিন বা চার ডলারে কিনি ঢাকায় তারচে বড় এবং টাটকা ফুলকপিটা বিক্রি হয় মাত্র পনেরো থেকে কুড়ি টাকায়। সবজি বাজারে গিয়ে বিক্রেতার সঙ্গে খামোখাই দামাদামি করতাম। বিক্রেতা প্রথম প্রথম আমার কথার প্যাঁচে পড়ে কঠিন দামাদামিতে অংশ নিতো। বারণ সত্ত্বেও এক রাতে মাযহার সেই সব্জিওয়ালাকে বলে দিয়েছিলো যে আমি কানাডায় থাকি। মাযহারের পাকা চুল আর গোঁফ দেখে সেই সব্জিওয়ালা আমাকে মাযহারের বিদেশে থাকা ছোটভাই ঠাউরেছিলো। বলেছিলো–আপ্নের বড় ভাইতো এইরকম দামাদামি করে না কোনোদিন! জবাবে আমি বলেছিলাম–মিয়া আমার সরল বড় ভাইটারে বোকা পাইয়া আপ্নেরা তারে ঠকান।

আমি যে মজা করি সেটা গোপনে একদিন সব্জিওয়ালাকে বলে দিয়েছিলো মাযহার। আর তাই লক্ষ্য করেছি দু’তিনদিন পর লোকটা দামাদামিতে আর আগ্রহী না হয়ে আমি যেটার যা দাম বলি সেই দামেই রাজি হয়ে যায়। কারণ টাকা দেবার সময় তাকে তার বলা বা নির্ধারিত দামই পরিশোধ করতাম। শুধু জিজ্ঞেস করতাম–কতো হইসে আপ্নের?
[আমি কানাডা চলে আসার পর সেই সব্জিওয়ালা নাকি মাযহারের কাছে আমার খোঁজ করেছিলো–স্যার, আপনার ছোটভাইটা আর আসে না যে! মাযহার বলে দিয়েছিলো আমি ওর ছোটভাই না মোটেই। আমরা বন্ধু। লোকটা নাকি বলেছিলো, আপ্নের বন্ধুটা খুব মজার মানুষ। হে খামাখাই আমার লগে দামাদামি করতো!]

এক রাতে মাছের অংশে ঢুকে এক মাছ বিক্রেতার ডালায় কতোগুলো বড় সাইজের পাবদা দেখে তো আমার পাগল হবার দশা! ঝকঝকে চকচকে তরতাজা পাবদাগুলোর শরীর থেকে হালকা সবুজ আর হালকা হলুদে মাখামাখি একটা মৃদু আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো। ডালার ওপরে ঝুলে থাকা তীব্র শাদা লাইটের আলো কী রকম ঝিলিক দিচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে সেই মাছেদের শরীরে। কিনে ফেললাম ঝটিতি অন্য কেউ কিনে নেয়ার আগেই। মাযহারকে বললাম–মিয়া পাবদা আমি কানাডাতেও পাই। কিন্তু সেগুলো থাকে বরফের ব্লকের ভেতর। ফ্যাকাশে শাদা রঙ ওদের। বাংলাদেশের পাবদার শরীরের হালকা সবুজ-হলুদের আভা তাতে নেই। পরাণ ভইরা খাইতে হবে মাখামাখা ঝোলে বঙ্গদেশীয় টাটকা পাবদাসুন্দরীদের।

পরদিন রান্না হলো পাবদা। সিদ্ধান্ত হলো রাতে বাড়ি ফিরে অনুষ্ঠিত হবে আমাদের পাবদা ভোজন। কিন্তু সেই রাতে আমার ফেরা হলো অনেক দেরিতে। মাযহার ফোন করলো কয়েকবার–কই তুমি? খাইবা না? আমি বললাম–আইতাছি। কিন্তু আমার আসা হয় না সহসা। অনেক দেরিতে ফিরলাম সেদিন এবং আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে এসেছি ভিন্ন একটা চক্করে পড়ে। সুতরাং খাওয়া হলো না পাবদা। এভাবে পর পর চার রাত্রি একই ঘটনা ঘটলো।(দুপুরে আমি আর মাযহার বাইরে খাই।) ফলে আমার আর খাওয়া হলো না ভয়ংকর সুন্দর সেই পাবদা মাছের মাখামাখা ঝোলে একাকার গরম ভাতের আইটেমটা! এখনো ঘুমের ভেতরে আমি সেই ঝকঝকে চকচকে পাবদাগুলোকে দেখি। বিপুল বিক্রমে ওদের অধিগ্রহণ করলেও আমার জানা ছিলো না যে–ওদের একটার গায়েও নাম লেখা ছিলো না আমার! হাহ হাহ হাহ।

কৈ মাছ নিয়েও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিলো নব্বুইয়ের দশকে। ১৯৯৪ সাল। আমি তখন আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারে থাকি। মাছ-মাংশ-সব্জি-ফল কিনি নিউমার্কেট কাঁচা বাজার থেকে। ওখানে পাওয়া যেতো দারুণ সব মাছ। এক বিকেলে একজন মাছ বিক্রেতার ডালায় দেখলাম বড় সাইজের চকচকে কালো শরীর হলুদ পেটের ডিমওয়ালা কিছু কৈ মাছ। মনে হয় যেনো সদ্য ধরা। একেবারে তরতাজা। খুব নড়াচড়া করছে। লাফাচ্ছে। মোটামুটি ভালো দাম দিয়ে কিনে ফেললাম এক ডজন। রাতের খাবারে ডায়নিং টেবিলে মচমচে কৈ মাছ ভাজার সঙ্গে এলাচিলেবু আর মশুরির ঘন ডাল এস্তেমালের স্বপ্নে বিভোর আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটা তেরো চৌদ্দ বছরের বাচ্চা ছেলে বললো–স্যার আমার কাছে দ্যান স্যার। আমি আপনেরে রিকশা পর্যন্ত দিয়া আসি। দ্যান আমার টুকরিতে দ্যান। আপ্নে বাজার সদাই করেন আমি আপ্নের লগে লগে থাকি।

‘ল ব্যাটা’ বলে আমি আরো কোনো ভালো মাছের সন্ধান করি। এদিক ঘুরি সেদিক ঘুরি। আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে ছেলেটা। এক পর্যায়ে পেছন ফিরে আর তো দেখি না ছেলেটাকে! কই গেলো কই গেলো? কই গেলো কৈ মাছ? হারামজাদা পালিয়েছে। আমার কৈ মাছগুলো নিয়ে পালিয়ে গেছে বদমাশটা।

মনটা একটু খারাপই হলো। কেনাকাটার মুডটাই অফ হয়ে গেলো। আজ কিছুই কিনবো না ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে যাচ্ছি কাঁচা বাজার থেকে। মনটাকে ভালো করার জন্যে নিজেকে নিজে সান্তনা দিলাম, আহারে গরিব ছেলেটা বাড়িতে গিয়ে আজ ডিমওয়ালা কৈ মাছ ভাজা দিয়ে খুব মজা করে ভাত খাবে। খাক না।

রিকশায় উঠেই মনটা আমার প্রসন্ন হয়ে উঠলো। আমার মনে পড়ে গেলো হিন্দি সিনেমায় শোনা গানটা–দানে দানে পে লেখা হায় খানেওয়ালেকা নাম। হাহ হাহ হাহ।
(ভালো থাকিস রে হারামজাদা। তোর কোনো দোষ নেই। ঐ বারোটা কৈ-এর একটার গায়েও আমার নামটা লেখা ছিলো না রে। বরং তোর নাম লেখা ছিলো কয়েকটায়। আর সে কারণেই আমি নিজের টাকায় কিনে পলিথিনের ডাবল ব্যাগে থাকা ডিমওয়ালা খুব দামি কৈমাছগুলো তোর হাতে তুলে দিয়েছিলাম!)


২০১৯-এর বইমেলার দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় গিয়েছিলাম দু’সপ্তাহের জন্যে। আমি অতিথি ক্যান্টনমেন্টে, মানিকের বাসায়। সেই সময়ে জসিম মল্লিকও অবস্থান করছিলেন ঢাকার বনানীতে তার বন্ধু ফাতেমা বেগমের বাড়িতে। জসিম আর আমার দেখা হয় নিয়মিত, প্রায় প্রতিদিন। প্রায় দুপুরেই আমরা বাইরে খাই। কখনো কখনো আমাদের সঙ্গী হন মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ। এক দুপুরে জসিমের আসার কথা গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে। কিন্তু দুপুরে নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে জসিম আমাকে ফোন করে বললেন, ভাইয়া আমার বন্ধু ফাতেমা বলছে অন্য কোথাও খেতে না যেতে। সে আপনাকে আমাদের এখানে আমন্ত্রণ জানাতে আগ্রহী। আমি ঠিকানা এসএমএস করে দিচ্ছি। আপনি চলে আসেন প্লিজ!

শুনে আমার তো মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।–ধুর্মিয়া আপনি জানেন আমি কারো বাসায় যেতে চাই না। তাছাড়া আমি আপনার বন্ধুকে চিনিও না। তাঁর সঙ্গে কোনোদিন আমার দেখাও হয়নি। বাড়িটা তার। আপনি আমাকে যেতে বলছেন। আমি তো যামু না মিয়া। আপনি থাকেন ঘরে। আমি আসবো না সরি।

জসিম খুব দ্রুত বললো–প্লিজ ফোন ছাড়বেন না। আমার বন্ধু পাশেই আছে। সে আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যেই বসে আছে। না আসেন অন্তত কথা বলেন তার সঙ্গে।

আমি বললাম–দ্যান। ঝামেলা পাকাইলেন মিয়া খামাখা।
অপর প্রান্ত থেকে জসিমের বন্ধু ফাতেমা বললেন–হ্যালো রিটন ভাই আজকে রেস্টুরেন্টে না খেয়ে আমার এখানে খাবেন প্লিজ! পুঁই শাক রান্না করেছি। লাল শাক আছে। করল্লা আছে। আর আছে ইলিশ ভাজা। সঙ্গে ডাল। খুবই সাধারণ। কিন্তু আপনার ভালো লাগবে।

আমি বললাম–আয়োজনটা মোটেই সাধারণ নয়। ইলিশ ভাজা আমার খুবই প্রিয়। পুঁই শাকও। কিন্তু আমার তো আসা হবে না আজকে। আরেকদিন আসবো ভাই। কিছু মনে করবেন না।

ফাতেমা নাছোড়–আপনি আমাকে চেনেন না বলেই আসতে চাইছেন না। আমাকে না চিনলেও আমার বাবাকে আপনি হয়তো চিনতেও পারেন।
–কে আপনার বাবা?
–আমার বাবার নাম আবুল কাসেম। বিটিভির অনুষ্ঠানের নৃত্য পরিচালক ছিলেন।
–বিটিভির ছোটদের অনুষ্ঠানের বিখ্যাত নৃত্য পরিচালক কাসেম ভাইয়ের মেয়ে আপনি? একটা ভেসপা মোটর সাইকেল চালাতেন যে কাসেম ভাই। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। আপনি জানেন আমার বহু অনুষ্ঠানের তিনিই ছিলেন নৃত্য পরিচালক?
–জ্বি জানি তো। সেই জন্যেই তো জোর করছি আপনাকে। আমার জন্যে না হলেও আমার বাবার কথা ভেবে অন্তত আসেন রিটন ভাই। আপনি এলে আমার খুব ভালো লাগবে।
আমি বললাম–এক্ষুণি আসছি।

জসিমের ওপর রাগটা আমার ঠান্ডা হয়ে গেলো মুহূর্তেই।


বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার রচনা ও পরিচালনায় প্রচারিত বেশ কয়েকটা ‘ছোটদের ঈদের বিশেষ’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নৃত্য পরিচালক ছিলেন আবুল কাসেম। ছোটখাটো কৃষ্ণবর্ণ হাসিখুশি মানুষটা ছিলেন খুবই সরল প্রকৃতির। একেকটা অনুষ্ঠানের পেছনে খাঁটাখাটনি করতেন প্রচুর। প্রযোজক ফখরুল আবেদীন দুলাল একদিন ফান করে বলেছিলেন আমাকে–তুই চিন্তা করিস না আব্বা। রেকর্ডিং-এর সময় কাসেম ভাই ক্যামেরার পিছনে পোলাপাইনগো লগে নাইচ্চা দিবো।

আসলেই। এরকম দৃশ্য আমি নিজেই দেখেছি একাধিকবার। মঞ্চে একদল ফুটফুটে বাচ্চা যখন দলীয় নৃত্যালেখ্যে নাচছে, ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে একই মুদ্রায় নাচছেন কাসেম ভাই–যাতে বাচ্চারা কোনো ভুল না করে। যাতে বাচ্চাগুলো প্রয়োজনে তাঁকে ফলো করতে পারে।

ফাতেমা আমাকে খুব আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে ডায়নিং স্পেস পেরিয়ে ওদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলেন। একটা সাইড টেবিলের ওপর টেন-টুয়েলভ সাইজের একটা ফটোফ্রেমে কাসেম ভাইয়ের আবক্ষ ছবি। সাধারণত পাসপোর্টের জন্যে এরকম ছবি তোলা হয়ে থাকে, স্টুডিওতে। ফটোফ্রেমে ফুলের একটা মালা।

দেয়ালেও বেশ কিছু ছবির ফ্রেম। গ্রুপ ছবি। সেখানেও কয়েকটায় আছেন কাসেম ভাই। আর আছেন ফাতেমা। নৃত্যশিল্পী ফাতেমা একজন স্কুল শিক্ষক। এছাড়া বাবার গড়া ঝংকার ললিত কলা একাডেমির সিইও তিনি। অনেক কথা হলো ফাতেমার সঙ্গে। অধিকাংশই তার বাবা সম্পর্কিত।

ফাতেমা জানালেন, তার স্বামী নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। স্কুল থেকে তাদের নাতনিকে নিয়ে ফিরবেন। এবং সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই।

ডায়নিং টেবিলে জসিম, ফাতেমা আর আমি কথা বলতে বলতে সময় কাটাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি। আমার সঙ্গে আসা ড্রাইভার ছেলেটার কথা বললাম ফাতেমাকে। ড্রাইভার এনামুলেরও আমাদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা ছিলো আজ দুপুরে। ফাতেমা সঙ্গে সঙ্গে এনামুলকে ডেকে আনলেন। আমি আমাদের সঙ্গেই এনামুলকে বসালাম। ভালো লাগলো দেখে যে ফাতেমা তাতে সামান্যতম বিব্রত হলেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নাতনীকে নিয়ে ফাতেমার স্বামী ফিরলেন। ক্লাশ এইটে পড়া নেগান নামের চটপটে হাসিখুশি মেয়েটা এসেই আমাকে খুব আন্তরিক একটা হাগ করলো। সে খুব খুশি। কারণ তাদের বাড়িতে একজন শিল্পী এসেছেন। (ফাতেমা আমাকে জানিয়ে রেখেছিলেন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া নেগান নামের মেয়েটা শিল্পীদের খুব ভালোবাসে। তিনি তাই মেয়েটিকে টেলিফোনে বলে রেখেছেন লুৎফর রহমান রিটন বিখ্যাত একজন শিল্পী।)

পায়জামা পাঞ্জাবি আর টুপি পরা ফাতেমার স্বামী ভদ্রলোককে প্রথম দর্শনে একজন আধা হুজুর আধা হুজুর আলাভোলা ধরনের মানুষ মনে হলেও বাস্তবে তিনি তা নন। তিনি ক্যাপ্টেন শামীম আহমেদ। বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলট ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। খুবই সহজ সরল আর হাসিখুশি মিশুক ব্যক্তি ক্যাপ্টেন শামীম। এরপর স্নান সেরে ভেজা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে টিংটিঙে স্বাস্থ্যের ছোটখাটো যে মেয়েটা আমাদের সঙ্গে শামিল হলো সে ফাতেমার কন্যা। নেগানের মা। নাম তার গুলসেতাইন আহমেদ। চটপটে স্মার্ট গুলসেতাইন নামের মেয়েটাও ওর বাবার মতোই পাইলট। একটি বেসরকারি বিমানে পাইলট হিশেবে কাজ করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন ইংরেজি নিউজ প্রেজেন্টার। কিউট একটা বেড়ালও আছে এই পরিবারে। ফাতেমার ছোট মেয়ে নিষ্ঠা থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি পরিবার।

অপরূপ একটা বাঙালিয়ানা আছে ফাতেমার মধ্যে। ডায়নিং টেবিলে খাদ্যসামগ্রীগুলো পরিবেশন করা হয়েছে মাটির সানকি, মাটির ডিস এবং মাটির বাটিতে। পানির জগ আর গেলাসটাও মাটির। মাটির থালায় ভাজা ইলিশ-পুঁই শাক-লাল শাক-করল্লা আর ডাল খেতে খেতে কালো টিপ পরা ফাতেমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। এই মেয়েটার মুখের হাসিতে ওর বাবা নৃত্য পরিচালক আবুল কাসেমের একটা আদল ফুটে উঠছিলো বারবার।

সহসা আমার দৃষ্টি গেলো ড্রয়িং রুমের দিকে। আমি দেখলাম–দরোজায় স্লাইডিং গ্লাসটা সরিয়ে শিশুর সারল্যভরা হাসিতে উদ্ভাসিত কৃষ্ণবর্ণ ছোটখাটো একটা মানুষ দাঁড়িয়ে। হাত তুলে আমাকে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে খুব নিচুস্বরে বললেন–রিটন ভাই আপনি আমার মেয়ের বাড়িতে আসছেন আমি খুব খুশি হইছি ভাই! খুব খুশি হইছি!
মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই তিনি মিলিয়ে গেলেন।

পৃথিবীটা একটা রহস্যময় জায়গা। আমার মনে হয় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া পরিচিত মানুষেরা নানা উপলক্ষ্যে নানা অজুহাতে তাদের প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যেই ফিরে ফিরে আসেন। নইলে অগস্ত্য যাত্রার প্রায় তিন দশক পরে কাসেম ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হবে কেনো? তার কন্যা ফাতেমার বাড়িতেই বা কেনো যাবো আমি!

তবে সব কিছু ছাপিয়ে হিন্দি সিনেমার সেই গানটা ফের মনে পড়ে গিয়েছিলো আমার–দানে দানে পে লেখা হায় খানেওয়ালেকা নাম। আধ ঘন্টা আগেও জানতাম আমি খেতে যাবো গুলশানের বিখ্যাত একটি রেস্টুরেন্টে। কিন্তু ফাতেমাদের বাড়িতে ভাজা ইলিশের একটা টুকরোয় আমার নামটা এমন অমোচনীয় হরফে লেখা ছিলো যে জসিমের প্রযত্নে নিয়তি আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে এসেছে বনানীতে।

জয় বাবা ফেলুনাথ! হাহ হাহ হাহ।

‘জীবন জীবন্ত হোক তুচ্ছ অমরতা’…

অটোয়া ০৬ মে ২০২০