কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ

লুৎফুর রহমান লুৎফুর রহমান

সম্পাদক ও সিইও, বায়ান্ন টিভি

প্রকাশিত: ১০:৫৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৫, ২০২১ 434 views
শেয়ার করুন


হেফাজতে ইসলামের সহিংসতার পর চলমান পরিস্থিতিতে দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানো নিষিদ্ধ করেছে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী বোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। রোববার বোর্ডটির স্থায়ী কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

সভায় কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রচলিত সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবেন বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ দিন আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া মাদ্রাসায় এ সভা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান।

সভায় দেশের কওমি অঙ্গনে বিরাজমান অস্থিরতা থেকে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাব্যবস্থার সুরক্ষা এবং উলামায়ে কেরামের শান ও মান বজায় রেখে স্বাভাবিক অবস্থায় নানামুখী দিনি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নিতে আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী কর্মসূচি ও পরবর্তীতে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে সহিংসতার কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা যখন সমালোচনার মুখে, ঠিক তখন কওমিকে রাজনীতিমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে আরও পাঁচটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো হলো- এখন থেকে কোনো বোর্ড বা ব্যক্তি এককভাবে মাদ্রাসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সিদ্ধান্ত নেবে হাইয়াতুল উলয়া। কওমির ছাত্র, শিক্ষক, আলেম-ওলামা, ইমাম ও মুসল্লিদের মুক্তি দেওয়া এবং নিরীহ আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হয়রানি না করতে সরকারকে আহ্বান জানানো, হিফজ ও মক্তব এখনই এবং কওমি মাদ্রাসা রমজানের পর খুলে দিতে সরকারকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে সরকারকে জানাতে হাইয়াতুল উলয়ার তিনজন প্রতিনিধি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে শিগগির দেখা করবেন। কমিটির প্রধান গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার মহাপরিচালক হাফেজ রুহুল আমিন সমকালকে বলেন, বৈঠকের সব সিদ্ধান্ত হাইয়াতুল উলয়ার ফেসবুক পেজে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। কারও ব্যক্তিভাবে কিছুই বলার নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়সূচি এখনও নির্ধারণ হয়নি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সমকালকে বলেন, মাদ্রাসার বিষয়ে কথা বলতে আলেম-ওলামারা দেখা করতে চান। হাইয়াতুল উলয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান টেলিফোন করেছিলেন। সোমবার সকালে সাক্ষাতের সময় জানানো হবে।

বৈঠকের আলোচনা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি সংস্থাটির স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্য। বেফাকুল মাদরাসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সহসভাপতি হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী। তিনিও বৈঠকের আলোচনা নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। ‘কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রচলিত সর্বপ্রকার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবে’- এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে কি-না, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যা লেখা আছে, তাই আমাদের বক্তব্য। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা খোঁজার মানে নেই।’

তবে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মাদ্রাসা খোলা, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিরোধী মতের রাজনৈতিক নেতাদের মাদ্রাসা থেকে দূরে রাখা এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বন্ধ করার বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে।

মোদির সফরবিরোধী কর্মসূচিতে সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি অফিস ও রেলস্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের কর্মীরাও। এ ঘটনার পর হেফাজতের ১৭ জন কেন্দ্রীয় নেতাসহ কয়েকশ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজত নিজেকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করলেও সংগঠনটির আমির ও মহাসচিব বাদে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশ এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অর্ধেকের বেশি নেতা বিভিন্ন ইসলামিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস বাংলাদেশের নেতারাই দেশের অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক ও শিক্ষক। ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি কওমিভিত্তিক দলগুলোর নেতারা হেফাজতেরও নেতা। অভিযোগ রয়েছে, তারা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেন।

হাইয়াতুল উলয়ার বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, কওমি অঙ্গনে বিরাজমান অস্থিরতা থেকে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাব্যবস্থার সুরক্ষা এবং উলামায়ে কেরামের শান ও মান বজায় রেখে স্বাভাবিক অবস্থায় দ্বীনি কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের শুরুতে হাইয়াতুল উলয়ার প্রয়াত কো-চেয়ারম্যান মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।

কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তরের সমমানের স্বীকৃতি দিতে ২০১৮ সালে সংসদে আইন পাসের পর গঠিত হয় হাইয়াতুল উলয়া। দেশের ছয়টি কওমি শিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ে সরকার স্বীকৃত এই সংস্থা গঠিত হয়েছে। সংস্থাটি কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষা গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে। এর প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন শাহ আহমদ শফী। তার মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হয়েছেন গুলশান আজাদ মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হাসান। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কিত যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে হাইয়াতুল উলয়া। এর অধীন কোনো বোর্ড, সংগঠন বা ব্যক্তি কোনো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে না। হাইয়াতুল উলয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এবং কওমি মাদ্রাসা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে হাইয়াতুল উলয়ার অধীন পাঁচ বোর্ড থেকে পাঁচজন, সর্ববৃহৎ বোর্ড বেফাক থেকে পাঁচজন এবং চেয়ারম্যান মনোনীত পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ১৫ সদস্যের ‘বাস্তবায়ন সাব-কমিটি’ গঠিত হবে।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বেফাকের সহসভাপতি আবদুল কুদ্দুস, সাজিদুর রহমান, আবদুর রহমান হাফেজ্জী, আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মুছলেহুদ্দীন রাজু, উবায়দুর রহমান মাহবুব, মহাসচিব মামুনুল হক, সহকারী মহাসচিব মুফতি নুরুল আমীন, মুফতি জসীমুদ্দীন, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গার সভাপতি মুফতি রুহুল আমীন, মহাসচিব শামসুল হক; আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের প্রতিনিধি ফুরকানুল্লাহ খলীল, আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীমের প্রতিনিধি এনামুল হক, মহাসচিব আবদুল বছীর; তানজীমুল মাদারিসের সভাপতি মুফতি আরশাদ রাহমানী, মহাসচিব ইউনুস এবং জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি ইয়াহইয়া মাহমুদ প্রমুখ।