এক মানবিক পুলিশের নাম শওকত হোসেন

মাহবুব জয়নুল মাহবুব জয়নুল

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৪:০৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১ 715 views
শেয়ার করুন

রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে কোনো ভারসাম্যহীন অসুস্থ রোগী পড়ে আছেন। ওই রোগীর এক হাত ও এক পা অর্ধেকজুড়ে পচে গেছে, শরীর থেকে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। এমন রোগী থেকে সবাই মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেও পরম যত্নে তাদের চিকিৎসা দিয়ে ভালো করে তুলছেন সুপারহিউম্যান খ্যাতিপ্রাপ্ত মানবিক পুলিশ সদস্য মুহাম্মদ শওকত হোসেন।

শওকত হোসেন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মানবিক পুলিশ শাখার টিম লিডার হিসেবে কর্মরত আছেন। ১০ বছর ধরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) সহকারি হিসেবে কাজ করছেন। বাড়ি নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধা

শওকত প্রতিদিনই সরকারি ডিউটি শেষে কোনো না কোনো ভারসাম্যহীন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে সুস্থ করে তুলছেন। এসব ভারসাম্যহীন রোগীকে দেখভাল করতে গিয়ে তিনি তার চাকরিজীবনে গত ১০ বছরে নিজের জন্য একটি পোশাকও কিনতে পারেননি। পারিবারিক ও অফিসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন সহকর্মীর পোশাক পড়ে। তার বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকা ব্যয় হচ্ছে অসহায় এসব রোগীর পেছনে। এমনকি এ সব রোগীর জন্য নিজের নামীয় ২টি ফার্মেসীও বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

যেভাবে সুপারহিউম্যান খ্যাতিপ্রাপ্ত মানবিক পুলিশ হয়ে উঠলেন শওকত

মুহাম্মদ শওকত হোসেন পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে ২৪তম ব্যাচে যোগ দেন ২০০৫ সালে। তখন তার মূল বেতন ছিলো ২ হাজার ৮৫০ টাকা। সবকিছু মিলিয়ে বেতন পেতেন ৫ হাজার টাকা। ওই সময় আর্থিক অনটনে দিন অতিবাহিত করতেন তিনি। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা ধৈর্য ধরতে বলতেন। বাবার অভয়ে তার পুলিশে পথচলা শুরু। ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। এরপর বদলি হয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে আসেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষার অধীনে মেডিকেলের ওপর ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ও ২ বছরের মেয়াদী প্যারা মেডিকেলের বিষয়ের উপর লেখাপড়া করেন।

ভারসাম্যহীন, প্রতিবন্ধী অসহায় রোগীর পাশে সুপারহিউম্যান খ্যাত মানবিক পুলিশ সদস্য শওকত হোসেন ২০০৯ সালে কিছুদিন রাঙামাটিতে কর্মরত থাকার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে বদলি হন। দায়িত্ব ছিলো রাঙামাটি থেকে আসা আহত পুলিশ সদস্যের সেবা দেয়া। এরপর তাকে ওটির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন থেকে তার বিভিন্ন রোগীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ফুটপথে পড়ে থাকা ভারসাম্যহীন অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে এনে সুস্থ করে তুলতেন তিনি। প্রথম দিকে তিনি নিজেই একা কাজ করলেও এখন তার টিমে সহযোগী আছেন ১০জন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো রোগীকে হাসপাতালে এনে সুস্থ করে তুলছেন তিনি ও তার টিম।

শওকত হোসেন বলেন, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা রোগী, যাদের শরীর থেকে ছড়াতো দূর্গন্ধ, এমন মানুষের পাশে কেউ যেতেন না, সবাই মুখ ফিরিয়ে চলে যেতেন। আমি মনে করতাম, এই মানুষটি তো আমিও হতে পারতাম বা আমার ভাইও হতে পারতো। এই চিন্তা নিজেকে ভাবনায় ফেলে দেয়। এরপর একদিন নিজেই উদ্যোগী হয়ে অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে এনে সুস্থ করে তুলতাম।

তিনি বলেন, প্রায় সময় এমন রোগী পেতাম কারও হাত, কারও পা ও কারও মুখ পচে গেছে। এসব রোগীর শরীর থেকে পচন ধরে পোকাও বের হচ্ছে। এমন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। নিজের টাকায় প্রতিদিন নতুন কাপড় কিনে তাদের পড়াতাম। সেই কাপড়ে প্রস্রাব, পায়খানা করলে কাপড়টি বদলিয়ে নতুন আবার কাপড় পড়াতাম নিজ হাতে এভাবেই বিভিন্ন ভারসাম্যহীন রোগীদেরকে সুস্থ করে তুলতাম।

চাকরিজীবনে গত ১০ বছরে নিজের জন্য একটিও নতুন কাপড় কেনেননি উল্লেখ করে শওকত বলেন, অসহায় রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। তবে অনেকে এগিয়ে এলেও টাকার পরিমাণ অপ্রতুল। নিজের বেশিরভাগ টাকা এসব রোগীর পেছনে চলে যাওয়ায় ১০ বছরে এমনকি ঈদেও নতুন পোশাক কিনিনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম সহকর্মীর পোশাক পড়ে। পরিচিতজনকে বলতাম, আমার কিছু গরীব মানুষের জন্য কাপড়-চোপড় দরকার। তখন তারা যে কাপড়গুলো দিতো, তা থেকে অসুস্থ রোগীকে দিতাম, নিজেও পড়তাম।