২৮ ডিসেম্বর, এই সময়ের অন্যতম উজ্জ্বল কবি ফকির ইলিয়াসের ৫৮তম জন্মদিন। ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন।
ফকির ইলিয়াস মূলত কবি। প্রাবন্ধিক, গল্পকার, গ্রন্থসমালোচক, সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি- লালন ও চর্চায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এযাবৎ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা বাইশ’টি।
সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার’ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস ‘মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার’- গ্রন্থ দুটিতে তিনি দক্ষতার সাথে বর্ণনা করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের চাওয়া-পাওয়া। বাংলার চিরায়ত মরমী ধারার সহস্রাধিক গানের পদকর্তা এই কবি।
তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হচ্ছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক, কানাডা, সুইডেন,ইতালী, অষ্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রে। ওয়েব, ব্লগ, ই-নিউজ গ্রুপেও তিনি লিখছেন নিয়মিত।
সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি- ‘ফোবানা সাহিত্য পুরষ্কার’, ‘ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরষ্কার’, ‘কবিতাস্বজন প্রীতি সম্মাননা’, ‘মৃত্তিকায় মহাকাল আবৃত্তি উৎসব স্মারক’-পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘ঘুংঘুর’ এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। এছাড়াও অনেকগুলো ওয়েব পোর্টালের- প্রধান সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, উপদেষ্টা সম্পাদক,
এডিটোরিয়াল বোর্ড মেম্বার, কান্ট্রি এডিটর এর দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
তিনি ‘দ্যা একাডেমী অব আমেরিকান পোয়েটস’ , ‘দ্যা এ্যমেনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল’ , ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিষ্টস’ , ‘আমেরিকান ইমেজ প্রেস’, – এর সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন বহু বছর যাবৎ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে- ১। বাউলের আর্তনাদ (গান-১৯৮৫), ২। হৃদে গাঁথা মালা (গান-১৯৮৯), ৩। এ নীল নির্বাসনে (কবিতা-১৯৯১), ৪। অবরুদ্ধ বসন্তের কোরাস (কবিতা-১৯৯৬), ৫। দাক্ষিণ্য বিষয়ক দিন (কবিতা-১৯৯৮) ৬। বৃত্তের ব্যবচ্ছেদ (কবিতা-২০০১), ৭। অনন্ত আত্মার গান (গান- ২০০২), ৮। কবিতার বিভাসূত্র (প্রবন্ধ- ২০০৯), ৯। চৈতন্যের চাষকথা (গল্প-২০১০), ১০।গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ (কবিতা-২০১১), ১১।ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম (কবিতা-২০১২), ১২।গৃহীত গ্রাফগদ্য (কবিতা-২০১৪), ১৩।অনির্বাচিত কবিতা (কবিতা-২০১৫), ১৪। সাহিত্যের শিল্পঋণ (প্রবন্ধ-২০১৬)। ১৫।মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার (প্রবন্ধ-২০১৭) ১৬।মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার (উপন্যাস-২০১৭) ১৭।শহীদ কাদরী’র দরবারের দ্যুতি (প্রবন্ধ-২০১৮) ১৮।প্যারিস সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা (কবিতা-২০১৮) ১৯।নক্ষত্র বিক্রির রাতে (কবিতা-২০১৯) ২০।সম্মোহিত শব্দদাগ (প্রবন্ধ-২০১৯) ২১। গ্রহান্ধ ঘরের কাহিনি (কবিতা-২০১৯) ২২। ধানমণ্ডির ধ্বনিপুত্র ( কবিতা- ২০২০)। সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থটিতে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়েই লেখা কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে।
সাংবাদিকতার সাথে তাঁর সংযুক্তি প্রায় চার দশকেরও বেশি সময়ের। তিনি বিভিন্ন সময়ে যেসব মিডিয়ায় দায়িত্ব পালন করেছেন এর মাঝে রয়েছে- উত্তর আমেরিকা প্রতিনিধি – দৈনিক আজকের কাগজ, ঢাকা। [জানুয়ারি ১৯৯২ থেকে অক্টোবর ২০০৬ ], যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি- দৈনিক সিলেটের ডাক, সিলেট। [জানুয়ারি ১৯৮৯ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮], যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি – সাপ্তাহিক জনমত, ইংল্যান্ড। [ জানুয়ারি ১৯৯০ থেকে ডিসেম্বর ২০০৯], যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি – সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন, ঢাকা [ জানুয়ারি ১৯৯০ থেকে ডিসেম্বর ২০০২], নিউইয়র্ক প্রতিনিধি – সাপ্তাহিক সময়, ঢাকা [ জানুয়ারি ১৯৯৩ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০১]।
সহধর্মিনী কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি এবং দুকন্যা নাহিয়ান ইলিয়াস ও নাশরাত ইলিয়াসকে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন নিউইয়র্কে।
কবি ফকির ইলিয়াস-এর কবিতাগুচ্ছ
মুখোশ অথবা খোলসের আদিকথা
আমরা অনেকগুলো সমুদ্র একসাথে পাড়ি দিতে দিতেই
দেখলাম; কয়েকটি ঢেউ বদলে ফেলছে তাদের মুখোশ।
আমরা অনেকগুলো পাহাড় অতিক্রম করতে করতেই
দেখলাম; অনেকগুলো ছায়া বদলাচ্ছে তাদের খোলস।
কিছু মানুষ খুব কাছে দাঁড়িয়ে তা দেখছে।কিছু অতৃপ্ত
সূর্যচূর্ণ মুখ লুকোচ্ছে প্রতিবেশী মাটির প্রাচীন পাঁজরে।
.
অনেক কৌশলই মানুষ শিখেছে প্রকৃতির কাছ থেকে।
অনেক বনজ ওষুধি;সেবন করেই আরোগ্য লাভ করেছে
মানুষ।কিন্তু জন্মচিহ্ন আঁকা মুখের আদলটি বদলাতে
চাইলেও তা তারা পারে না। যেটুকু এই সবুজ থেকে
মানুষের মৌলিক আত্মায় গৃহীত হয়- তার কোনও
পরিবর্তন হয় না। যেটুকু ঝরে পড়ে,কিংবা যে অংশ
খসে যায় হাওয়ায়,তাকে আমরা খুঁজে পাই না আর!
.
একটি দীর্ঘশ্বাস এসে দেখা পায়,কয়েকটুকরো নীলাভ ফেনার!
সম্ভ্রান্ত বৃষ্টির চোখে
সম্ভ্রান্ত বৃষ্টির চোখে ছড়িয়ে যাই আমার সকল বিনয়। আবার অশ্রু নামুক এই-
নদীজলে, এই বঞ্চিত মানুষেরা- যারা পুড়ে যাচ্ছে অবরুদ্ধ হিংসার আগুনে, তাদের
দিকে তাকিয়ে নেমে আসুক আকাশ। নামুক ঝড়। তছনছ হয়ে যাক এমন মসনদ
যেখানে কোনোদিনই অনাহারী মানুষের ছায়া পড়েনি। কোনোদিনই,
মজুরের স্বপ্ন ভেদ করতে পারেনি সেই দেয়াল ঘেরা কুরসির শরীর।
.
আমার বিনয়গুলো আবার কবিতা হোক।আবার দুহাত উঁচু করে এই শিশুরা
বলতে শিখুক- এই দেশ আমার, এই স্বাধীনতা আমার।
অবরুদ্ধ মাটির কিনারে দাঁড়িয়ে যে চিত্রশিল্পী রক্তছবি আঁকছেন,
তার তুলির পাশে পুষ্প হয়েই ফুটে উঠুক আমাদের মানচিত্র।
আর,
এইসব পুড়ন্ত মানুষের পাশেই অবনত হোক আমাদের হাতের শেষ গোলাপ।
উপাত্তের উত্তরবৃত্ত
সংরক্ষণ করে রাখছি উৎসব। যারা দুঃখ গেঁথে রাখে,
তাদের জন্য নির্মাণ করে যাচ্ছি বাঙময় জীবন। আর
নীরবতার দরজা খুলে দেখে নিচ্ছি খুঁটে খাওয়া
পাখিদের মুখ।পতঙ্গের ঘুমবিহার এবং গ্রহদের গার্হস্থ্যজীবন।
জানি এমন দর্শক সকলে হতে পারে না। এমন আয়ু’কে
আরাধ্য করে সবাই সাজাতে পারে না বাগানের সিঁড়ি।
কিংবা যে পাপড়ি অনাদরে পড়ে থাকে, অনেকেই
অনুধাবন করতে পারে না তাদের বেদনাবোধ।
আপাতত উপাত্তের খনিগুলো ঘিরে যাচ্ছি নিজের
ছায়া দিয়ে। এতকাল যে রক্ত স্পর্শিত হয়নি,
সেই প্রবাহের উত্তরবৃত্তে লিখে যাচ্ছি নতুন
পরমাণুজীবনের বন্দোবস্তপত্র।
পুনরায় জিজ্ঞাসার দিকে
প্রাচীন পৃথিবীর দিকে ফিরেও তাকাই’নি। তারপরও
আমাকে বললে আদিম! প্রেম বাদ দিয়ে-
বৃক্ষস্মৃতি নিয়েই সাজাতে চাইলাম কুঠির।
তারপরও আমার পরিচয় হলো গৃহহারা।
তবে যাদের কিছুই থাকে না- মূলত তারাই
কি সার্বভৌম সুজন !
আমি আজীবন রূপান্তরের গল্পই লিখেছি।
কবিতার খাতা খুলে-
যে অবাধ্য শব্দগুলোকে করে নিয়েছি আপন,
শেষ পর্যন্ত তারাই আমার সাথে থেকেছে।
কোনো মানুষ আমার সহযাত্রী হতে চায়নি।
ব্রিজ ভাঙার শব্দ
টাইপরাইটারে লিখে রাখছি সেতু পার হবার ধ্বনি।
যারা শুনতে পাচ্ছে না, অথবা যারা শুনতে পাচ্ছে-
তাদের সকলের জন্যেই সাজাচ্ছি লোহার পাতে
জমে থাকা শব্দ, শব্দের ঘর।
যে খনিতে একদিন বাস করতো আগুন,
আমি সেখান থেকেই তুলে আনছি জলবেদনা।
যে স্তব্ধতার শিয়রে শুয়ে থাকতো শিকল,
আমি তা ভেঙে নির্মাণ করছি নতুন জানালা।
ব্রিজগুলো ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখে যে পাখিগুলো
বার বার কেঁদেছিল আমি তাদের বলছি,
তোমার উড়ে যাও।এই মাটি তোমাদের
ছায়া মনে রাখবে। এই নদীর গহীনে থেকেই যাবে
তোমাদের জন্মঢেউগুলো।
মর্মমিটার
জরাক্রান্ত রাতের গল্প বলি-
কেউ করেনি উত্তাপ পরিমাপ
হাত বুলিয়ে চাঁদ আর তারার গায়ে
বলেনি,প্রেমই-সকল আদিম পাপ।
আমি তো ছুটেছি পাপের পরত খুলে
পূণ্যগুলোকে কুড়িয়ে তুলবো বলে
কল্পকাহিনি মিথ্যে প্রমাণ করে
মিশবো প্রেমেই শাশ্বত কৌশলে।
যাবো না কোথাও,এখানে দাঁড়িয়ে থেকে
হিংসে বিরোধী সমাবেশগুলো ডেকে
কাতারবন্দি মানুষের হাতে হাতে
একটি করে গোলাপ যাবো রেখে।
মর্মমিটারে উষ্ণতা খুঁজবে কেউ
এরপর জানি বুকের পাঁজরে তার
একাকী আগুনে সাজিয়ে ভবিষৎ
ডাক দিয়ে যাবে আবার, প্রথমবার।