গান পাগল ছেলেটা হয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার

কাউছার আলম কাউছার আলম

পটিয়া, দক্ষিণ চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ৭:৪০ অপরাহ্ণ, জুলাই ৭, ২০২০ 1,606 views
শেয়ার করুন
ছোটবেলা থেকে খুব গান পাগল ছিলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি গান করা আর বড় হয়ে মিউজিসিয়ান হবো এমনটাই লক্ষ্য ছিল সায়েম ইমরানের। স্কুলজীবন থেকেই পড়াশোনা করার পাশাপাশি একাধারে বিতর্ক করতাম, বক্তৃতা দিতাম, আবৃত্তি করতাম, রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে সরব ছিলাম। তাই সারা জীবন শুধু বইয়ের পাতায় আটকে না থেকে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেও যখন যেভাবে পেরেছি জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা-বাবা। বাসায় পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা কখনোই চাপ দেননি। সব সময় বলতেন, সার্থক মানুষ হও। এমন ভাবেই নিজের কথা ব্যক্ত করে সদ্য প্রশাসন ক্যাডারে বিসিএস পাশ করা সায়েম ইমরান।
 
পটিয়া উপজেলার পৌরসভার উত্তর গোবিন্দরখীল এলাকার ৯ নং ওয়াডের আলী মুন্সির বাড়ির বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পটিয়া উপজেলার ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর ও কামরুন নাহারের দুই ছেলের মধ্যে সায়েম ইমরান বড় সন্তান। ছোট ভাই সাঈদ ইমরান সদ্য পাশ করে বের হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতি বিভাগে অনার্স মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে।
 
মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেছি কলেজিয়েট স্কুল হতে ২০০৫ সালে এসএসসি। পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ বৃত্তি ও অষ্টম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পাই। মাধ্যমিকে এ প্লাস পেয়েছি। তারপর হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে এ প্লাস পাই ২০০৭ সালে। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০০৮ – ২০০৯) শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে সেশনজটের কারণে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বের হই ২০১৭ সালে। স্নাতক সম্পন্ন করার পরে ২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্ম জীবনে পা দিই। স্নাতক সম্পন্ন করার পর ৩৮তম বিসিএস ছিল আমার জীবনের প্রথম বিসিএস। প্রথমবারেই বিসিএসে সফল হওয়ার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার হয়েছেও তা। সারাদেশে প্রশাসন ক্যাডারে সপ্তম স্থান অধিকার করি।
 
বিসিএসের পেছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ছিল আমার বাবা মায়ের । বাবা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। সেই চেতনা থেকেই তিনি ছেয়েছিল আমি ও যেন দেশ মাতৃকার সেবায় নিয়োজিত হতে পারি। আল্লাহপাক তাদের দোয়া কবুল করেছেন।
 
বিসিএস প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শুরুতে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এত এত পড়া আর এত কম সময়ে কিভাবে সম্ভব? তাই শুরুতে কিছুদিন হতাশ হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর কিছুদিন বিরতি দিয়ে চিন্তা করলাম, আমি কোন বিষয়ে ভালো পারি। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বিজ্ঞান আর গণিতই আমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। ভাবলাম, এ দুই বিষয়ের প্রস্তুতি এমনভাবে নিতে হবে, যেন এখান থেকে ১ নম্বরও মিস না হয়। প্রিলিমিনারির জন্য বাজারের ভালো মানের এক সেট বই কিনে পড়াশোনা শুরু করলাম। গণিত ও বিজ্ঞানের সিলেবাস যখন শেষ করলাম, তখন বেশ আত্মবিশ্বাস পেলাম। তারপর ধীরে ধীরে বাংলা, ইংরেজি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, বাংলাদেশ বিষয়াবলির সিলেবাস দেখে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। প্রতিটি সিলেবাস ভাগ করে নিলাম। টার্গেট নিতাম ছোট ছোট। যেমন, আজকে ৩০ পৃষ্ঠা পড়ব, ওই ৩০ পৃষ্ঠা খুব ভালোভাবে পড়ে নিজে নিজেই পরীক্ষা দিতাম। এভাবেই খুব অল্প সময়ে সিলেবাস শেষ করেছি। আর প্রচুর মডেল টেস্ট দিয়েছি। এটা খুব উপকারে আসে। ঘড়ি দেখে সময় ধরে মডেল টেস্ট দিতাম। দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত পড়েছি। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, আন্তর্জাতিক পাতা ও অর্থনীতির পাতা সময় নিয়ে পড়েছি। যার ফলে সাধারণ জ্ঞান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় অনেকবার মনে হয়েছে যে শুধু পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশ-বিদেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখা উচিত।লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয় পয়েন্ট আকারে লেখার চেষ্টা করেছি। সংবিধান ভালোমতো পড়ায় মোটামুটি সব জায়গায় এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। আপনি যা জানেন তা যদি সঠিক হয় তাহলে সেটার ব্যবহার অবশ্যই করবেন এবং এমনভাবে করবেন, তা যেন পরীক্ষকের চোখে পড়ে।
 
জীবনের প্রথম বিসিএসে ৩৮তম মেধাক্রম অর্জন করে প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডারে আসতে পারা সত্যি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। প্রশাসন ক্যাডারে সামনে যাঁরা আসতে চান, তাঁদের বলব, জীবনে স্বপ্ন দেখলে আর সেই স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করলে সে স্বপ্ন পূরণ হয়ে যায়।
 
সায়েম ইমরান বলেন, আমি আসলে সারাজীবনই পাবলিক রিলেশন নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। মানুষকে সাহায্য করা বা মানুষের পাশে দাড়ানো সবসময়ই আমার মধ্যে খুব কাজ করতো। নিজের মত করে যতটুকু পজিটিভ থাকা যায় তার চেষ্টা সারাজীবনই করছি। আমার ইচ্ছা গুলো সৎ ছিল বলে আল্লাহ আমাকে আজকে এই সূ্যোগটা দিয়েছেন। আর মানুষকে সাহায্য করার জন্য যদি কোনো চাকুরি থাকে তাহলে প্রশাসনে তার সুযোগ সবচাইতে বেশি বলে আমি মনে করি।
 
গান পাগল সায়েম গানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের পপুলার কোচিং সেন্টার গুলোতে ক্লাস নিতেন।
 
ছেলে সায়েম ইমরান সম্পর্কে বাবা মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধে যাওয়াতে আমার বেশিদুর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। পড়েছি পটিয়া কলেজে এসএসসি পর্যন্ত। তাই তাদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। বেশি করে পড়াশোনা করিয়ে দেশ ও দশের খেদমত করতে পারে মতো। আমি আশা করব সে যেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তি যোদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যদা সমুন্নত রাখে।