শাবিপ্রবিতে “শিক্ষা ও গবেষণা” ইনস্টিটিউট চালু করা সময়ের দাবী

প্রকাশিত: ৭:১১ অপরাহ্ণ, জুলাই ৭, ২০২০ 773 views
শেয়ার করুন
শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল মানুষের আচরণের ইতিবাচক পরিশুদ্ধিতার জন্য, জীবনকে জানার জন্য,পরম সত্যকে জেনে মানার জন্য এবং মানবিকতাকে জাগ্রত করার জন্য। শিক্ষা প্রবাহমান রূপরেখা যেখানে জাতি সত্তার জন্ম ও বিকাশ সাধন হয়ে থাকে।
 
মানুষের সার্বজনীন গুণাবলীর বৈচিত্রময় ইতিবাচক পরিবর্তন ও বর্তমান পুজিবাদী বিশ্বে মানব সম্পদ উন্নয়ন,পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ফলপ্রসূ মাধ্যম হলো শিক্ষার সুদীর্ঘ পথ। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে মানুষ জ্ঞান অর্জন করেছে নানাভাবে নানাপথে নানামতে। কখনো সঠিক ধারায় আবার কখনো ভুলের মধ্য দিয়ে মানুষ চলেছে দীর্ঘকাল জ্ঞানের খুঁজে,বিশুদ্ধতার নির্যাসে নিজেকে সিক্ত করে সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ মানব হয়ে ওঠে শুদ্ধ মহামানবে। শিক্ষার কথা বলতে গেলেই চলে আসে সভ্যতার কথা। মানব সভ্যতার সূচনা হতে শিক্ষা জীবন সর্ম্পকিত অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। শিক্ষা মানুষকে মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলে, নিয়ে যায় ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে এবং উন্নয়নের মহীসোপানে।
 
শিক্ষা মানুষের সার্বজনীন গুনাবলীর বিকাশ ও মানব সম্পদ পরিবর্তনের নিরব বিপ্লবের সুঠাম হাতিয়ার। সভ্যতা ও সমাজ পরিবর্তন-পরিবধর্নে বদলে যায় শিক্ষার রূপকাঠামো।ব্যবিলনীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা,গ্রিক সভ্যতা,রোমান সভ্যতা,চৈনিক সভ্যতা,সিন্ধু সভ্যতাসহ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সভ্যতার যুগে পরিবর্ধিত পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষা।মানুষের চিন্তা-চেতনা, সার্বিক ভাবনা, দর্শন, ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে শিক্ষার প্রভাবে।একটি জাতি যত শিক্ষিত হবে ততই উন্নত জীবনের স্বাদ পাবে। প্রকৃত শিক্ষাই একমাত্র মানুষের বিবেক বুদ্ধির রুদ্ধ দ্বার খুলে দেয়,অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বেলে দেয়।
 
আমাদের জীবনে শিক্ষার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম।বাস্তবজগতের কর্মদক্ষতার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলো কার্যকরী শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার সঠিক ও কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে একটি জাতিসত্তা পিছিয়ে পড়ে।সময়ের আয়নায় পিছু ফিরে তাকলে সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
 
আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয় “একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য”। প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে ১৯৭১ সালে আর এখন ২০২০ চলমান। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা পরিবর্তন ও এর কতটা উন্নয়ন হয়েছে তা অবশ্যই চোখে পড়ে। শিক্ষার উন্নয়ন শিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে গেলে দৃষ্টি ফেরাতে হবে পিছু ফিরে। অবশ্য এর
আগে জেনে নেয়া চাই শিক্ষার পরিচয়। সহজ অর্থে শিক্ষা হচ্ছে ব্যক্তি যা কিছু শেখে। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অর্ন্তনিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয়া হয় এবং একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অজর্নই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বোঝায়।
 
বাংলা শিক্ষা শব্দটি সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে উদ্ভুত হয়েছে। অর্থ হচ্ছে শাসন, নির্দেশ, আদেশ, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education এসেছে ল্যাটিন শব্দ Educare বা Educatum থেকে। যার অর্থ To lead out মানে ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। শিক্ষা হলো গতিশীল সামাজিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা ছকে বাধা কোন প্রত্যয় নয় বরং এর ব্যাপকতা অসীম। অসীমের মাঝে সীমারেখা টেনে শিক্ষাকে নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ করা যায় না। স্থান কাল পাত্র জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে বৈচিত্রপূর্ণ মানবিক চাহিদার আলোকে শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
 
মহামতি সক্রেটিসের মতে, “মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কার হলো শিক্ষা”।
 
জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেন, “আর্দশ মনুষ্যত অর্জনই হল শিক্ষা। মিথ্যার অপনোদন, সত্যের আবিষ্কার কিংবা আর্দশ মানুষ হতে হওয়ার মাধ্যমে একজন মানুষকে প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত করে তুলে শিক্ষা।
 
শিক্ষা মাধ্যমে পরিবর্তন আসে দেশের সকল ক্ষেত্রে সকল স্থানে, আলোকিত হয় আমাদের চারপাশ, এগিয়ে যায় প্রিয় দেশ।
 
বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি। আমাদের মাতৃভূমির অন্যতম একটি বিভাগ হলো ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বিভাগ সিলেট। এই বিভাগের মোট আয়তন ১৫,৫৫৮ বর্গ কি.মি। সিলেট জেলার আয়তন ৩.৪৫২ বর্গ কি.মি., সুনামগঞ্জ জেলার আয়তন ৩,৬৭০ বর্গ কি.মি., হবিগঞ্জ জেলার আয়তন ২,৬৩৭ কি.মি, মৌলভীবাজার জেলায় আয়তন ২,৭৯৯ বর্গ কি.মি.। সিলেট বিভাগের পূর্বে ভারতের আসাম, উত্তরে মেঘালয় রাজ্য (খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়),দক্ষিণে ত্রিপুরা রাজ্য আর পশ্চিমে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে উঁচু উঁচু পর্বত শ্রেণির পাহাড়িয়া অঞ্চল, মেঘালয়, খাসিয়া জৈন্তিয়া এবং ত্রিপুরা পাহাড়ের মাঝামাঝি বিস্তীর্ন এলাকাটিই হচ্ছে সিলেট বিভাগ। প্রাচীনকাল হতেই বহু ভাষাভাষী জাতি,বর্ণ, গোষ্ঠী নিয়েই বেড়ে ওঠেছে এই বিভাগটি। এই অঞ্চলে প্রাচীনযুগ হতেই অস্ট্রেলীয়,মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতিভুক্ত
সম্প্রদায়রে বসবাস ছিল যার ফলে ভাষার বেলায় রয়েছে দারুণ বৈচিত্র। নাগরি,ফার্সি,আরবীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের ভাষার প্রচলন ছিল এই বৃহৎ অঞ্চলে। সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে – “সিলেট বিভাগের অধিবাসীরা সাহিত্য চর্চায় বাংলাদেশের পথিকৃৎ। এ বিভাগের অধিবাসীরা বাংলা ভাষা ও ছিলটি ভাষা সহ বহুভাষায় সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য রেখেছেন।
 
পনের’শ শতাব্দী হতে শুরু করে এ যাবৎ সিলেটবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন সেগুলো হলো –
১. সংস্কৃত ২. বাংলা ৩. সিলেটি নাগরি ৪. আরবী ৫. ফার্সি ৬. উর্দু ৭. হিন্দি ৮. ফরাসি ৯. স্প্যানিশ ১০. বিঞ্চুপ্রিয়া মণিপুরী ১১. অসমিয়া ও ১২. ইংরেজি।”
 
বর্তমান সময়ে সিলেট বিভাগের সিংহভাগ জনগণ শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার করেন এবং ঘরোয়া আড্ডা-আলাপে সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় ভাব বিনিময় করে থাকে।এতক্ষণ এতসব লিখার একটি উদ্দেশ্য আছে।
 
সিলেট বিভাগের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংস্কৃতি শিক্ষা প্রাচীনকাল হতেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশ। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরাই শিক্ষাগুরু হিসেবে সর্বত্র বিবেচিত হতেন। সিলেটের মৌলভীবাজারের ভাটেরায় প্রাপ্ত তা¤্রলিপির একটি বিবরণে পাওয়া যায় যে রাজকীয় শিক্ষা প্রসার ও যজ্ঞ উপলক্ষে মিথিলা ও কৌনুজ হতে ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসা হতো। তখনকার সময়ে সিলেটের পঞ্চখন্ড, রাজনগর, গোলাপগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে টোল ও চতুষ্পাঠীতে গুরুগৃহে শিক্ষা নিতো শিক্ষাথীরা। টোল জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় যিনি গোটা ভারতবর্ষে সুনাম অর্জন করেন তিনি হলেন পন্ডিত রঘুনাথ শিরোমণি। তিনি অবিভক্ত উপমহাদেশের বিখ্যাত জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপ পর্যন্ত প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেছিলেন। জ্ঞানের স্বর্গরাজ্য নবদ্বীপে সিলেট বিভাগকে নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে সেটি হলো “শ্রীহট্ট মধ্যমা নাস্তি” যার অর্থ হলো সিলেটের লোক হয় উত্তম, নয় অধম, মধ্যম নেই। বৈঞ্চব ধর্মের প্রর্বতক শ্রী চৈতন্যদেব, জগন্নাথসহ বহু পন্ডিতের জন্ম এই সিলেটে। হিন্দু যুগ আর মুসলিম শাসনামলে এ অঞ্চলে শিক্ষার প্রচার-প্রসার হয়। তৎকালীন সময়ে মহাকবি সৈয়দ সুলতান,সৈয়দ মুসা, শেখ চান্দ, সৈয়দ শাহনুর, গীরিকা চন্দ্র নাগ, গৌরি শংকর, লীলা নাগ, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, অধ্যাপক আছদ্দর আলী,অধ্যাপক আজফর আলী, দেওয়ান হাছন রাজা, রাধামাধব দত্ত, রাধারমণ দত্ত, ডক্টর সুন্দরী মোহন, মেজর এম.এ.জি ওসমানীসহ গুণিজনের কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টায় বহুশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বৃহ সিলেট অঞ্চলে। কালের বির্বতনে শিক্ষাধারা ক্রমশ পরিবর্তিত পরিবর্ধিত হয়ে উন্নতির শিখরে পৌছে গিয়েছে।
 
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাবিপ্রবি)। ১৯৯১ সালের ১৩ ফেব্রয়ারি (১৩৯৭ বঙ্গাব্দ পহেলা ফাল্গুন ) মাত্র তিনটি বিভাগে ২০৫ জন শিক্ষার্থী ও ১৩ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।
 
আমাদের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক আন্দোলন ও সংগ্রাম করতে হয়েছে যা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে এরকম নজির নেই। ইতিহাসে ফিরে তাকানো প্রয়োজন কেননা আমাদের বিভাগের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ১৮৭৪ সালে আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। এই আসাম প্রদেশের অন্যতম অংশ ছিল সিলেট। আসাম প্রদেশে সিলেটের অর্ন্তভুক্তি নিয়ে যেমন সিলেটিরা নাখোশ ছিলেন তেমনি আসাম অঞ্চলের মানুষজনও নাখোশ ছিল। ১৯০৫ সালে সিলেট বাংলার অংশ হয় এবং ১৯১২ সালে আবার আসামের সাথে যুক্ত হয় সিলেট। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঐ সময় আমাদের সিলেটের মানুষজন চাইতেন তাদের অঞ্চলেও যেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯২৫-১৯৩৮ পর্যন্ত সময়কালে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এতগুলো আলোর মুখ দেখেনি বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। ১৯৪০ সালে সুনামগঞ্জের কৃতিসন্তান তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুনাওর আলী “শ্রীহট্ট বিশ্ববিদ্যালয়” নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন কিন্তু আসাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের বিরোধিতার ফলে তা একসময় নাকচ হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের দিকে আসাম ব্যবস্থাপনা পরিষদে মুনাওর আলীর প্রস্তাব গৃহিত হয়। তবে কথা আছে না অভাগা যেদিকে যায় সেদিকে নদীর জল শুকিয়ে যায় ঠিক সেটিই হলো সিলেট অঞ্চলের সাথে।
 
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে সিলেট পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয় যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাঙ্খিত চাওয়া পাওয়াতে রূপান্তর হয়নি বরং অপূর্ণই থেকে যায় সেই চিরকাঙ্খিত আশা। পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর দেশের ২য় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিভাগে। ১৯৬২ সালে শুরু হয় শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন। উল্লেখ্য এ সময়ও সরব আন্দোলন হচ্ছিল সিলেটে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সিলেটের কৃতি সন্তান স্পিকার হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর মা সিরাজুন্নেসা চৌধুরী এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৪ সালে আবার স্বপ্নভঙ্গ হয় সিলেটবাসী। বিভিন্ন দপ্তর হতে অনেক আশ্বাস দিলেও প্রতিষ্ঠা পায়নি জনসাধারণের বহু প্রত্যাশিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
 
১৯৬২- স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত নানা বাধা বিপত্তি বন্ধুর পথ অতিক্রম করলেও আমাদের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি বরং অবহেলায় পড়ে থাকে আমাদের প্রিয় সিলেট বিভাগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার সুদীর্ঘপথ সময়ের পর ১৯৮৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে এক বিশাল জনসভায় পল্লিবন্ধু হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ঘোষণা দিয়েছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ১৯৮৬ সালে ৩০ এপ্রিল সিলেট ভ্রমণকালে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করেন। এই ছিল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। বর্তমান সময়ে সিলেট অঞ্চলসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশে বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। সারাদেশে সর্বপ্রথম মোবাইলে এস.এম.এসের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। এছাড়াও ড্রোন আবিষ্কার, স্বল্প সময়ে ক্যান্সার রোগ নির্ণয়সহ বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি আবিষ্কার ও গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে । শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সময়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাঠদান করা হচ্ছে কিন্তু পরিতাপের কথা বৃহত্তর এই অঞ্চলের অন্যতম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে “শিক্ষা ও গবেষণা” ইন্সটিটিউট চালু হয়নি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ রয়েছে তবে শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে অধ্যয়ন করার সুবর্ণ সুযোগ নেই। এতে কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষজন শিক্ষার জ্ঞান হতে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে “শিক্ষা ও গবেষণা” একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। “শিক্ষা ও গবেষণা” বিষয়টা কী তা অনেকেরই জানা আছে তবুও আবার বলতে হচ্ছে কেননা শিক্ষার মান উন্নয়ন ও প্রসারে এ বিষয়ের অধ্যয়ন অতীব জরুরী। “শিক্ষা ও গবেষণা” বিষয়টি অধ্যয়নের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ধরণ, শিক্ষা পদ্ধতি, কার্যকরী পাঠদান, আনন্দ ও সহজতার সাথে শিখন শিক্ষণসহ নানাবিধ বিষয় সর্ম্পকে আলোচনা করার মাধ্যমে বিশদভাবে তুলে ধরা হয় বাস্তবচিত্র।
 
সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এড ও এম.এড চালু করা হয় এবং ১৯৯৪-৯৫ সালে শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা বিষয়ে অর্নাস কোর্স চাল হয়। এরপর একে একে রাজশাহী, চট্রগ্রাম, খুলনা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন পাবলিক- প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা বিষয়ে অর্নাস মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। “শিক্ষা ও গবেষণা” কিংবা “শিক্ষা বিজ্ঞান” যে নামেই অভিহিত করিনা কেন এর গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে এই বিষয়টির ভূমিকা সর্বাগ্রে। উল্লেখ্য বৃহত্তর এই অঞ্চলে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি টির্চাস ট্রেনিং কলেজে “শিক্ষাবিজ্ঞান” বিষয়ে ব্যাচলের অব এডুকেশন কোর্স চালু হয়েছে। “শিক্ষাবিজ্ঞান” বিষয়ে প্রথম ব্যাচ শুরু হয়েছিল ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান।
 
পদার্থ ও পরিসংখ্যান শাস্ত্রে গবেষণার পাশাপাশি প্রসিদ্ধ কয়েকটি ইন্সটিটিউট রয়েছে। সেগুলো হলো –
 
১. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট
২. স্থাপত্য গবেষণা কেন্দ্র
৩. কম্পিউটার প্রকৌশল গবেষণা কেন্দ্র
৪. পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র
৫. পরিসংখ্যান গবেষণা কেন্দ্র।
 
তবে এখানে “শিক্ষা” নিয়ে কোন গবেষণা করার সুযোগ নেই অথচ এটি দেশের অন্যতম একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান শিক্ষা ও গবেষণা একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়।
 
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ১ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে “শিক্ষা ও গবেষণা” ইন্সটিটিউট চালু করা সময়ের দাবি। আমাদের ভৌগোলিক পরিবেশ, সংস্কৃতির ভিন্নতা, বহুজাতি ও নৃতাত্তি¡ক মিশ্রণে আমাদের রয়েছে এক ভিন্ন সংগ্রামী ইতিহাস। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় বেড়ে ওঠা মানুষ বর্তমানে শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেছে পূর্বের তুলনায় একটু বেশি। প্রকৃতির সৌন্দর্য যেমন আমাদের চিন্তাভাবনায় মুক্ত করে তেমনি এর বৈরী হাওয়া আমাদের ভাবায়। সিলেট অঞ্চলজুড়ে রয়েছে অসংখ্য হাওর-বাওর। প্রাকৃতিক ভিন্নতার কারণে বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকে হাওরের এলাকাগুলো আবার রয়েছে চা বাগান শ্রমিকদের সন্তানেরা এখনো পড়ালেখায়, চিন্তা চেতনায় পিছিয়ে আছে, পরিবর্তনের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতির ভিন্নতাও শিক্ষার প্রসারে একটি বাধা।
 
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন “শিক্ষা ও গবেষণা” ইন্সটিটিউট চালু খুবই জরুরী। শিক্ষক কিভাবে পড়াবেন, শিক্ষাক্রম কিভাবে নির্ধারিত হবে, শিক্ষার কার্যক্রম কিভাবে চলবে, শিক্ষা সমস্যা সমাধান ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে গবেষণাসহ নানাবিষয় সুচারুরূপে আলোচিত হয় তেমনি আলোচিত হবে শিক্ষার সার্বিক প্রক্রিয়া কিভাবে ফলপ্রসূ করা যাবে। “শিক্ষাবিজ্ঞান” বা “শিক্ষা ও গবেষণা” অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি অধ্যয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা লাভবান হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখে যার ফলে শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়ন হয়। আর্দশ শিক্ষক, দক্ষ গবেষক, শিক্ষা প্রশাসক সহ নানা পদে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ রেখে শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় শিক্ষার মান উন্নয়ন পরিবর্তন পরিবর্ধনে শিক্ষা ও গবেষণার কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন কার্যকরী কোর্স চালু আছে যা অধ্যয়ন করে ঐসব দেশসমূহের জনশক্তি একসময় কর্মশক্তি হয়ে নিজেদের দেশের শিক্ষার মান উন্নয়ন করে যাচ্ছে নিরবে। উন্নত বিশ্বের যে সকল দেশের শিক্ষার মান উন্নত তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সকল দিক পরিপূর্ণ এবং বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয় দেশের অন্যতম একটি
বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো এখানে ‘শিক্ষা ও গবেষণা’ ইনস্টিটিউট চালু করা হয়নি এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
 
সিলেট বিভাগে চারটি জেলা রয়েছে, এই চারটি অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষার্থী, শিক্ষক রয়েছে যাদের প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষা আর সেটি সম্ভব হবে যদি এ বৃহত্তর অঞ্চলে ‘শিক্ষা ও গবেষণা” ইনস্টিটিউট শুরু করলে শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নতির শিখরে পৌছাতে পারবে। শিক্ষা ও গবেষণা হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পড়ানো এবং পড়ার একটি কার্যকরী প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে ব্যক্তি যেমন তার ভাগ্য বদল করতে পারে তেমনি ঐ ব্যক্তির যথাযথ ব্যবহারে একটি জাতির ভাগ্য গড়ে ওঠে নিপুণভাবে। শিক্ষার মান যত উন্নত হবে তত উন্নত হবে সেই জাতি কিংবা রাষ্ট্রের জীবনমান। আমাদের জীবন একটি অফুরন্ত সম্ভাবনার নাম তবুও হতাশার দমকা হাওয়ায় নিভে যায় লাল নীল দীপাবলির আলো কিংবা ঝলমলে রোদের সোনালী বিভা লুকিয়ে যায় ধূসর মেঘমালার আড়ালে।সমস্যা অতীতযুগে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিবর্তিত করেই এগিয়ে যেতে হবে। সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করাই তো শিক্ষার কাজ।শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ স্বপ্ন দেখে। যদি শিক্ষা বুিদ্ধতে রূপান্তর হয়না,ভাবনার সঞ্চালন করেনা তাহলে কখনোই বিজয়ী স্বপ¦বান হওয়া যায়না। দেশ ও দশের স্বপ্নকে সত্যি করতে হলে আমাদের এখনি ভাবতে হবে।
 
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে হবে। প্রকৃতির কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আমাদের এই সিলেট বিভাগের শিক্ষার মানউন্নয়নে একটি উদাহরণ দিতে পারি। উদাহরণটি হলো – গহীন অরণ্যের নিরব নিঃস্তবদ্ধ আঁধার প্রান্তরে ঝিঁঝি ডাকা জোঁনাকির ক্ষীণ আলোয় আলোকিত প্রহরে পথহারা বিহঙ্গ মগ্ন চৈতন্যে শিষ দিয়ে সমগোত্রীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পথ খুঁজে পাবার আশায়। তখন অরণ্যের অপর প্রান্তের সমগ্রোত্রীয়রা পথহারা সঙ্গী পাখির কন্ঠে সুর মিলিয়ে সহায়তা করার উদ্দেশ্য উড়ে চলে অকৃত্রিম ভালোবাসায়। ইতিবাচক পরিবর্তন পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্যামল কোমল অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী, পাহাড় পর্বত, জলপ্রপাত, হাওর-বাওর, নদী জল বিধৌত সিক্ত নীলাম্বরীর স্বর্গীয় ছোঁয়ায়, চা বাগানের সতেজ পাতার সুবাসে প্রকৃতির মুগ্ধ আবেশে সুশিক্ষার সুবিপ্লবে আবারো জেগে ওঠুক
প্রিয় সিলেট বিভাগ আর এটি সম্ভব হবে ‘শিক্ষা ও গবেষণা’ ইনস্টিটিউট চালু করার মাধ্যমেই।
 
_________________
মুস্তাফিজ সৈয়দ
লেখক: প্রাবন্ধিক