করোনাকালে পর্যটন ভাবনা: বাংলাদেশ কোন পথে?

মো. জামিউল আহমেদ মো. জামিউল আহমেদ

লেখক ও পর্যটন ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: ৮:৫৬ অপরাহ্ণ, মে ২৬, ২০২০ 807 views
শেয়ার করুন

করোনাভাইরাস একটি অতিদানব। তবে তার কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। বিশ্বের কোন এলাকায়, কোন আবহাওয়ায়, কোন বয়সের মানুষ তার টার্গেট হবে তা অনেকটাই পরিষ্কার। তাছাড়া মানুষকে সে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করে। কে ছোট, কে বড়, কে গরীব, কে ধনী, কে শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত এসব বাছবিচার তার মধ্যে নেই। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার এই নিয়মনীতির কিছুটা হলেও হেরফের পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্যাপারটি অণুজীব বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে এটা সত্য, এখানে করোনার নিয়মনীতি ঠিক থাকছেনা। এজন্য অবশ্য আমাদের বিশৃঙ্খলা আর অব্যবস্থাপনা একেবারে চাক্ষুস।

এমনটি আমাদের পর্যটন শিল্পেও। আজ অবধি এর ইতিহাস অন্তত তাই বলে। গোটা বিশ্বে পর্যটন চলে পর্যটনের নিয়মে আর বাংলাদেশে চলে আমাদের নিয়মে। এ নিয়মটা হচ্ছে আমাদের আমলারা যা ইচ্ছে পোষণ করেন তা। অবশ্য এজন্য শুধু আমলারাই নয় সরকারী-বেসরকারী উভয় খাতের ব্যর্থতাই বহুলাংশে দায়ী। যেজন্য বিশ্বে প্রচলিত নিয়মকানুন অনুসরণের কোন সংস্কৃতি যেন এখানে নেই। তার সাথে এসে যোগ হয়েছে করোনা তাণ্ডব। এই তাণ্ডবের প্রথম আঘাত পর্যটন শিল্পের উপর। ব্যাপারটা যদিও বৈশ্বিক তবুও আমাদের ক্ষেত্রে তা অনেকটাই আলাদা। তাহলে দেখা যাক তা কেমন করে।

করোনাভাইরাসের প্রথম দিককার বৈশ্বিক আঘাতের শিকার বাংলাদেশও। এতে স্বভাবিকভাবেই আমাদের পর্যটন শিল্প প্রথমেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অবশ্য গোটা বিশ্বের সার্বিক অবস্থা এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তাতে বলা মুশকিল কবে আবার ফিরবে পর্যটন। তারপরও সময়ের ব্যবধানে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বৈশ্বিক যে প্রয়াস তার সাথে আমরা চলতে পারিনি। করোনা মোকাবেলায় যেমনি হেলায় ফেলায় আমাদের সময় পার হয়েছে তেমনি পর্যটনের ব্যাপারেও তাই ঘটেছে। তবে, করোনার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিটি নির্দেশ ও উপদেশ মানা হলেও পর্যটনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার কোনো কিছুই আমলে নেয়া হয়নি। ইদানিং এসে একটু একটু সুর মেলানোর চেষ্টা থাকলেও তা বেসুরই থেকে যাচ্ছে। যেমনটি পরে হলেও ইদানীং মাননীয়ন পর্যট মন্ত্রী ইউ এন ডাবলু টি ও-এর ডায়লগে অংশগ্রহণ করে একদিন দুইবার কথা বলার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেন নি। কেন পারনে নি তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি আমাদের গুণধর আমলা-কামলারা কেউই অন্য কোন ফোরামে বা এসব আন্তার্জাতিক পর্যায়ের আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নি বা করছেন না। এই হচ্ছে আমাদের নড়বড়ে পর্যটন শিল্প।

অথচ অন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবিরাম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কিভাবে সরকারকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, দাতা দেশ ও সংস্থা, প্রতিবেশী দেশ, বেসরকারী খাত ইত্যাদি সবার সাথে নিয়মিত ডায়লগ চালাতে হবে। তার সাথে এই শ্বিল্প সম্পৃক্ত স্টেকহোল্ডার বা দায়কগোষ্ঠীর কার কি সমস্যা তা চিহ্নিত করে ব্যসস্থা গ্রহণ করা। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের অগ্রাধিকার দেয়া এবং ক্ষতিগ্রস্থ সবার জন্য প্রণোদনা ও ত্রাণের ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে সরকার বরাদ্দকৃত বাজেটে ও সম্পদে কাচি না চালায়। তার সাথে সরকারের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় পর্যটন অগ্রাধিকার পায় এবং বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়। একই সাথে পর্যটক আকর্ষণ ও গন্তব্যগুলোও আবার পর্যটক উপযোগী করে সাজাতে হবে। তেমনি করতে হবে সেবা দাতা বা পর্যটন ব্যবসায়ী ও সেবা গ্রহীতা বা পর্যটক সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত ভ্রমণে সচেতন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের সাহায্য সহযোগীতাও নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে বেসরকারী খাতও কিন্তু একেবারে লেজেগোবরে। চাকুরী হারানো পর্যটন কর্মীদের দেখার কেউ নেই। ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেহাল দশা। আর বড়রাতো দাঁত কামড়ে পেটে পাথর বেঁধে পড়ে আছে। অথচ প্রণোদনার বাতাস বইতে শুরু করার সাথে সাথে সবাই মিলে অযথা কোরাস গাইলেন। কিন্তু কেউ বুঝতে চাইলেননা কিংবা তাদেরে কেউ বুঝাতে চেষ্টা করলেননা শিল্পতো নয়ই অন্তত সেবা খাত হিসেবেও পর্যটনের স্থান কোথায় এবং প্রণোদনা প্রাপ্তির হিস্যাটাইবা কেমন। এতেকরে আশা-নিরাশার দুলাচলে দুলতে থাকলো সবাই। কেউ কেউ বুঝে না বুঝে বড় বড় আশ্বাসের বুলি আওড়ালো। অনেকে আবার নেতা হওয়ার সুযোগ কাজে লাগালো। এ নিয়ে হতে থাকলো সব এলাহি কাণ্ড। দেশে সরকার অনুমোদিত পর্যটন সমিতি রয়েছে ১০ টি এবং আঞ্চলিক ও পেশা ভিত্তিক ইত্যাদি মিলিয়ে আরো প্রায় ২০ টি। কিন্তু করোনার অবদানে এখন নতুন আরো জন্ম নিয়েছে অন্তত ২০ টি। মাশাল্লাহ, এবার মাঝি-মাল্লারাও নাকি পর্যটনের খেদমতগার সমিতি।

এতেকরে নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা, আর কচিনেতাদের ভার্চুয়াল বয়ান বাতাস ভারি করে ফেলেছে। যা কি না বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড বা বিটিবি’র নতুন সি ই ও মহোদয়ের পর্যটন বিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধিতে দারুণ সহায়ক হচ্ছে। কারণ সরকারী তরফে আর কাউকে না পেয়ে প্রথমেই সবাই টার্গেট করে বসে এই বিটিবি-কে। অথচ এই বিটিবি’র সীমাবদ্ধতার বিষয়ে কারো কোন স্বচ্ছ ধারণা আছে বলে মনে হয়না। আর এই বিটিবিও সবাইকে খুশি করার জন্য যে যা বয়ান করেছে তা চোখ বন্ধ করে লিপিবদ্ধ করেছে। এ দিয়ে তৈরী করেছে পর্যটনের সারা জীবনের সব সমস্যা ভিত্তিক এক ইয়া বড় খসড়া পরামর্শপত্র। এতে কি হবে তা একমাত্র আল্লাহ মালুম। কেন না এই মুহুর্তে এসব সমস্যার পাহাড় নয় শ্বিল্প বাঁচানোর জন্য যা করণীয় শুধু তাই বিবেচ্য। অথচ এই সুযোগে কিছু কিছু নেতা তাদের কার দেয়া কয়টা পরামর্শ সরকার গ্রহণ করেছে এই মর্মে প্রচার করে বগল বাজাচ্ছেন। অন্যদিকে এই নিয়ে সরকার তথা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত ট্যুরিজম ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি নিজেরাই ক্রাইসিসে।

সব মিলিয়ে বলা যায় পর্যটনও করোনাভাইরাস সংক্রমিত। করোনায় যেমনি আইডেন্টিফিকেশন; আই সি ইউ; অক্সিজেন; ভেন্টিলেশন ইত্যকার সমস্যার সাথে রয়েছে ব্যবস্থাপনা সমস্যা তেমনি পর্যটনেও সার্বিক অব্যবস্থাপনা প্রকট। একদিকে সরকার তথা সরকারী খাত কি করছে বা করতে চায় তা পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে বেসরকারী খাতও নানামুখী সমস্যায় নাকানিচোবানি খাচ্ছে। বিশেষকরে শিল্প সম্পৃক্ত সবার এক সাথে এক কন্ঠে কথা বলা এবং এক সাথে কাজ করার জরুরী যে প্রয়োজন তা একেবারেই অনুপস্থিত। এমনটি অবশ্য সব সময়েই ছিল এবং এখন আরো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কোন সমিতি বা কোন নেতা নেতৃত্ব দেবেন, কে কার চেয়ে বড় হয়ে যাবেন, কার অবদান কম হয়ে যাবে, কে বেশি জানেন ইত্যকার অহম আচ্ছামত পেয়ে বসেছে। যার সুযোগও আবার অনেকে নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় এই শিল্পকে দুর্যোগকালীন সময় কাটিয়ে কিভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আবার নতুনভাবে এবং নতুনরূপে যাত্রা শুরু করতে হবে তা নির্ধারণ করে এগুতে হবে। এজন্য সরকারী এবং বেসরকারী উভয় খাতের সকল অংশিদার ও দায়িত্ব সংশ্লিষ্টদের করণীয়গুলো নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।