তবুও ফুল ফোটে এ শহরে।। সাহিত্য

প্রকাশিত: ১০:২০ অপরাহ্ণ, মে ১৬, ২০২০ 543 views
শেয়ার করুন

 

পৃথিবীর সব শহরের মতই আমাদের তায়েফ শহরও এখন অবরুদ্ধ। বাৎসরিক ছুটি শেষ করে এ শহরে যখন ফিরে এসেছি দু’মাস আগে, তখনও করোনার এতোটা বিস্তার ঘটেনি সৌদি আরবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এদেশের চিত্রটাই বদলে গেলো।

এবারের ছুটিতে একসঙ্গে অনেকগুলো দেশে পা রেখেছিলাম; ঢাকা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া; ফিরতি পথে আবার ঢাকা হয়ে কর্মস্থল সৌদি আরবে। করোনা বিস্তারের আগে আগে অনেকেই বিভিন্ন দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন। আমার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। ভ্রমণসময়টা পুরোপুরিই আমাকে আনুকূল্য দিয়েছিল। ১৪ মার্চ যেদিন ঢাকা থেকে রিয়াদ বিমানবন্দর এলাম, শুনলাম সে রাত থেকেই বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে সৌদি আরবের বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদি আমি একদিন দেরী করে সৌদিতে আসার টিকিট কাটতাম, তাহলে এতদিন বাংলাদেশেই আটকে থাকতে হতো।

তায়েফ বিমানবন্দরে নেমেই দেখি হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েছেন তায়েফ ডেন্টাল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ হাসান আল ইয়ামানি। জানালেন, কাল যেন কর্মস্থলে না আসি। ১৪ দিন বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বললেন। সঙ্গনিরোধের এ দিনগুলো ছিল আতঙ্কময়। মনে হলো, এই বুঝি করোনার উপসর্গ দেখা দিল। মনে মনে ভাবলাম, এ সময়ে যদি আমার করোনার উপসর্গ দেখা দেয়, কর্মস্থলের সবাই ভাববে, আমি বাংলাদেশ থেকে করোনা ভাইরাস নিয়ে এসেছি। এতে আমাদের দেশের দুর্নাম হবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলাম, কোয়ারেন্টাইনের এ সময়ে যেন আমার করোনা ধরা না পড়ে। আমার দেশের দুর্নাম যেন না হয়।

কোয়ারেন্টাইন শেষ হওয়ার পরেও কর্মস্থলের লোকেরা আশ্বস্থ হতে পারেন নি। আমাকে বলা হলো আরো ১০ দিন বাসায় থাকতে। ১০ দিন পর আমি নির্বিঘ্নে কাজে যোগ দিতে সক্ষম হলাম। আমাদের হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া অন্য রোগী দেখা হচ্ছে না। প্রবেশপথে বসানো হয়েছে ‘ভিসুয়াল ট্রায়াজ’। আগতদের তাপমাত্রা দেখা হচ্ছে, হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে জীবাণুনাশী দ্রবণ। রোগীদের অপেক্ষা-গৃহ ফাঁকা, হাসপাতালের যে করিডোর রোগীর আনাগোনায় মুখরিত ছিল, আজ তা কেমন নীরব! রোগীদের অপেক্ষা-গৃহে দু’চেয়ারের মাঝখানে দুটো চেয়ার টেপ দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে, সামাজিক দূরত্ব পালনের ব্যবস্থা। আমি চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে ক্লিনিকে বসে থাকি। রোগী এলেই আৎকে উঠি! করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিনাতো?

বাইরে কোথাও যেতেও ভয়। স্থানীয় বাংলাদেশী গ্রোসারি শপে কেনাকাটার জন্য যেতে হয় বাধ্য হয়েই। ওখানে কিছু বাংলাদেশীর ভিড় লেগেই থাকে। সামাজিক দূরত্ব মানছে না এরা, মাস্ক পরেনা অনেকেই। বিদেশেও বাংলাদেশীদের চরিত্র বদলায়নি। কেনাকাটা করে ঘরে ফিরলে এক অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরে, আমি কি করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ঘরে ফিরলাম?

মসজিদের আজান কানে আসে। আজানে যুক্ত হয়েছে নতুন এক বাক্য, ‘সাল্লু ফি বয়ুতি কুম’- অর্থাৎ, ঘরেই নামাজ পড়ুন। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ‘সাল্লু ফি বয়ুতি কুম’ কেমন বেসুরো হয়ে উচ্চারিত হচ্ছে, কেমন করুণ মনে হচ্ছে তার কণ্ঠস্বর। আজানের হাজার বছরের চেনা সুরে এ কেমন বেসুরো বাক্যের আগ্রাসন ঘটলো!

ইতিমধ্যে কারফিউ শুরু হয়েছে শহরে। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার পথ বন্ধ। আমাকে কারফিউ অবস্থাতে চলাচলের অনুমতিপত্র দেয়া হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। বিকেলে ডিউটি থেকে বাসায় ফেরার পথে দেখি সড়কে সড়কে পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মী। চারপাশে কেমন আতঙ্ক, কেমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব! চেনা পথকে কেমন অচেনা মনে হয়!

এ রোজার মাসে কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। দোকানপাট খুলেছে সীমিত পরিসরে। সে সুযোগে এক বিকেলে বেরোলাম। পাঁচ মিনিট গাড়ি চালিয়েই পৌঁছে গেলাম ‘আল আনুদ সুপারমার্কেট’এ। মার্কেটের উল্টোদিকে ‘আল আনুদ পার্ক’। প্রতি বিকেলে যে পার্কে মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো, আজ তা ফাঁকা। পার্কের দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সারি বাঁধা জারুল গাছে ফুল ফুটেছে। নীল ফুলগুলো আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে দেয়ায় মগ্ন। মনে পড়ল, বসন্ত এসেছে শহরে।

এখন মে মাস, এ মাসেই গোলাপ উৎসব বসে তায়েফের রুদ্দাফ পার্কে। আর দু’মাস পরেই গ্রীষ্ম আসবে, তায়েফের শুরু হবে ‘মওসম আত তায়েফ’ বা তায়েফ মৌসুম, ‘স্যুক ওকাজ’ নামক স্থানে বসবে তায়েফের লোকঐতিহ্য মেলা। কিন্তু, এ বছর এসবের কিছুই অনুষ্ঠিত হবে না। করোনা নামের এক দৈত্য আমাদের ঘরবন্দী করে রাখবে। তবুও এ শহরে ফুল ফুটবে, পাহাড়ের উপত্যকায় ফুটবে বিখ্যাত ‘ওয়ার্দা আত তায়েফ’ বা তায়েফের গোলাপ, পথের কিনারে বাগানবিলাস হয়ে উঠবে গোলাপি, পার্কের জারুল ফুল হয়ে উঠবে আরো বেশি নীল। তায়েফের বসন্ত দেখার জন্য আবার কবে মুক্ত বাতাসে বের হতে পারব আমরা জানি না। শুধু জানি, হয়তো এমনিভাবে আমাদের ঘরবন্দী থাকতে হবে আরো অনেক দিন, অনেক মাস। -সিকদার নাজমুল হক,

 

  • তায়েফ, সৌদি আরব। ১৫ মে, ২০২০