মানুষ সুখ প্রত্যাশী– কিন্তু সবাই সুখী হয় না, কেউ কেউ হয়

প্রকাশিত: ১০:০২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১, ২০২১ 451 views
শেয়ার করুন

 

আপনি যদি সত্যিই জীবনে সুখী হতে চান, তাহলে কৃতজ্ঞ হতে শুরু করুন, পরিবারের সাথে আরো বেশি সময় কাটান, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করুন, দিনের একটা সময়ে কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে ধ্যানে মগ্ন হউন, সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে সরে এসে আরো একট বেশি ঘুমাতে চেষ্টা করুন। মানুষ সুখ প্রত্যাশী। কিন্তু সবাই সুখী হয় না। কেউ কেউ হয়।

এই সুখী হওয়াটা একেক জনের কাছে একেক রকম। দেখা যায়, যাতে একজন সুখী, অন্যজন তাতে অসুখী। সুখের ব্যাপারটি একই সঙ্গে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক। সুখ রহস্যাবৃত। কখনো বুঝা যায়, কখনো বুঝা যায় না। কখনো ধরা দেয়, কখনো ধরা দেয় না।অনেকে মনে করেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা বিশেষত খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান নিশ্চিত হলেই মানুষ সুখী হয়। এর সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি যোগ হলে হয় সোনায় সোহাগা। আসলেই কি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও সুস্বাস্থ্যের অধিকার মানুষকে সুখী করতে পারে? হয়তো পারে, হয়তো পারে না।মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার শেষ নেই। ভোগ ও ভোগেচ্ছার কোনো কমতি নেই। সচরাচর যা আছে, তাতে মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারে না। তার আরো চাই, আরো চাই। অবশ্য যদি কেউ অল্পে তুষ্ট হয়, তাহলে তার পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব। কিন্তু অল্পে তুষ্ট মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। অধিকাংশ মানুষ অতৃপ্ত, অসন্তুষ্ট, অসুখী।অনেকে মনে করেন, ধন-সম্পদ, জনবল এবং ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মধ্যে সুখ লুকিয়ে আছে।

যাদের এসব আছে, তারাই সুখী। আসলেই কি তাই? আমরা এই করোনাকালে যা দেখছি, তাতে বলতে পারি না যে, এসবের মধ্যে সুখের কোনো ঠিকানা আছে। বিপুল ধন-সম্পদ আছে, সন্তান-সন্তুতি ও আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই, ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে সস্পর্ক আছে এবং প্রতিপত্তির কোনো শেষ নেই- এমন ব্যক্তিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে অসহায়ভাবে পথে-ঘাটে মারা যাচ্ছে।তার সম্পদ, ক্ষমতা, প্রভাব কোনো কাজে আসছে না। সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন পালিয়ে যাচ্ছে। কোনো মানুষ যদি তার শেষ যাত্রায় প্রিয়জন ও অনুগ্রহভাজনদের উপস্থিতি ও স্পর্শ না পায়, কারো চোখে অশ্রুর রেখা না দেখতে পায়, দোয়া থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত হয়, তাহলে তার সুখ কীসে? ধন-সম্পদ, জনবল, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কোনো কিছুই দুনিয়াতে তার উপকারে আসলো না। পরকালে আসবে কি না আল্লাহ মালিকই বলতে।সুখের কোনো বিশেষায়িত সংজ্ঞা নেই। একে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। অনেকটাই উপলব্ধির বিষয়। আমরা কি আসলেই সুখী হতে চাই? হয়তো সারাজীবন এ প্রশ্ন থেকেই যাবে। তাতেও প্রকৃত সুখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুখ খুঁজতে গিয়ে হয়তো অসুখেও ভুগতে হতে পারে। যদি ছোটবেলায় ফিরে যাই, তবে আমরা এভাবে সুখ খুঁজতাম।

যখন স্কুলে যেতাম; ঠিক তখন মনে হতো পৃথিবীর সব সুখ মনে হয় আমাদের। সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রামের মাঠ চষে বেড়ানো। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। স্কুল পালানোর পায়তারা। পকেটে সামান্য দু’-চারটি টাকা হলে বুক ফুলিয়ে বলা, ‘আজ সারাটা দিন আমার’। বাটার বন আর বাকি টাকা দিয়ে বুট-বাদাম খেয়ে বন্ধুদের সাথে জম্পেস আড্ডা দেওয়া। আহা, স্কুল পালানোর দুরন্তপনা অসাধারণ এক সুখকর স্মৃতি। চাহিদা বলতে কোনো একটি মাঠে খেলতে পারলেই চাহিদার ষোলোকলা পূর্ণ হতো। প্রয়োজন ছিল না দামি শার্ট, দামি প্যান্ট, আধুনিকতার ছোঁয়াও গায়ে লাগেনি। নাড়া (খড়) ক্ষেতে বিকেল বেলা খেলতে পারার মাঝেই লুকিয়ে ছিল সব সুখ। ছিল না কে ধনি, কে গরিব- তার বৈষম্য। বন্ধু-বন্ধুই। ছিল না কোনো প্রেসটিজ ইস্যু। শিক্ষিত-মূর্খ ছিল না বিভেদ। কার কোন ধর্ম, তা নিয়েও ছিল না মাথাব্যথা। গাদা গাদা বই পড়ার এত সময় ছিল না। প্রকৃত সুখ তো খুঁজে পেতাম সবুজ-শ্যামল মাঠের বুকে ঘুরে বেড়ানোয়। বর্ষায় কাঁদাযুক্ত মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে ছিলাম। বাড়ি থেকে বলতে হয়নি পড়তে বসো। ইচ্ছে হলে পড়তাম, না হলে দূর ছাঁই, এত সময় কই? লুকোচুরি খেলতাম আমার এক প্রিয় বন্ধুদের সাথে।

এখন আর কেউ কৃষক হতে চায় না, শ্রমিক হতে চায় না, থাকতে চায় না গ্রামে। শহরের টানে, জীবিকার সন্ধানে ছুটে যায় ইট-পাথরের শহরে। সেখানে সুখের সন্ধান করতে গিয়ে অসুখের তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। তবু লোকে সুখ খোঁজে। ভালোবাসায়ও সুখ আছে। সে সুখ খুঁজতে গিয়ে মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না/জানি না লোকে যা বলে, সত্য কী না/কপালে সবার নাকি সুখ সয় না/সবাই তো সুখী হতে চায়।’ভালোবাসার মাঝে যে সুখ লুকিয়ে আছে, তা-ও স্বার্থপরতার কাছে মাঝে মাঝে হার মেনে যায়। কখনো সংসারে অভাব, কখনো বা চাহিদা মেটানোর তাগিদ। সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা এক জীবন। যে জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ঘানি বেশি টানতে হয়। অতঃপর যখন সুখ এসে সত্যিই ধরা দেয়, ঠিক তখন নতুন কোনো অসুখে সেই সুখটাও বিনষ্ট হতে চলে। সুখ খোঁজার জন্য দুঃখকে বরণ করতে যেন মহাব্যস্ত গোটা পৃথিবী। গোটা পৃথিবী এখন বৈষম্যের চাদরে ঢাকা। যে যেভাবে পারছে; সেভাবেই বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। সুখের সন্ধান করতে গিয়ে অন্যের জান-মাল নিয়েও ছিনিমিনি খেলছে। নীতি-নৈতিকতার বড়ই অবক্ষয়। সবাই শুধু গাড়ি-বাড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে সত্যিকারের সুখটাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। তবু আমরা সুখের জন্য দুঃখের বীণায় সুর তুলছি অবিরত।